মোদির চ্যালেঞ্জ ভারতের কৃষক আন্দোলন

মো. নিজাম উদ্দিন
মো. নিজাম উদ্দিন  © সংগৃহীত

ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার এখন কৃষক আন্দোলনে দিশেহারা। কৃষকদের এক নজিরবিহীন আন্দোলন শামাল দেওয়ার কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছে না সরকার। বিজেপি সরকারের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর সাথে কৃষক নেতাদের দফায় দফায় আলোচনায়ও কোনো ফলাফল আসছেনা। কৃষকদের কী সেই দাবি? যার জন্য ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের ডাক দিলো কৃষকরা? চলুন একটু সেদিকে নজর দেই।

ঘটনার সূত্রপাত গত জুন মাসে নরেন্দ্র মোদি সরকারের তিনটি কৃষি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কৃষি অধ্যাদেশগুলো আইনে পরিণত করার পর কৃষক সংগঠনগুলো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাজ্যসভায় এই তিনটি আইন পাস করতে সরকার কোনো আলোচনার পথেই হাঁটেনি। বিরোধীরা সংসদে প্রতিবাদ করলে ঐ অধিবেশন থেকে আটজন এমপিকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবাদ থামেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় কৃষকদের চূড়ান্ত আন্দোলন। যার নাম ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলন। যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতের গ্রামের কৃষকরা।

ভারতের কৃষকদের আন্দোলন হলেও এই আন্দোলনের ঝাঁজ এখন ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতের এই আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ঘটনায় কানাডা কৃষকদের পাশে থাকবে বলেও জানিয়েছেন ট্রুডো। মোদি সরকার যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। কানাডায় শিখদের সমর্থন আদায় ট্রুডোর রাজনৈতিক কৌশল হলেও ভারতের কৃষক আন্দোলন এখন আর ছোট ব্যাপার নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৩৬ জন এমপি এই আন্দোলনে কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।কথা বলছেন। চাপ তৈরি করছেন। কৃষক আন্দোলনের অগ্রভাগে আছে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শিখ কৃষকরা। তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বহিঃর্বিশ্বের শিখ সম্প্রদায়।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানিসহ বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ করছে। সুতরাং বলাই যায় ভারতের কৃষক আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। যেটি মোদি সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর।

বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষকরা এখন দিল্লিতে অবস্থান নিয়েছে। কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দাবি না মানলে দিল্লি অচলের কথাও ভাবছে। দিল্লি থেকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর মত নেতারা এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালও দিল্লিতে অবস্থান নেয়া কৃষকদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। চল্লিশটি কৃষক ইউনিয়নের নেতারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে। অসংখ্য রাজনৈতিক দল কৃষকদের সুরে কথা বলছে। আওয়াজ তুলছে। ফলে মোদি সরকার এই কৃষক আন্দোলন শামাল দিতে একেবারেই হিমশিম খাচ্ছে। বিজেপি হয়ত ভাবতেও পারেনি যে মোদি তুড়ি মেরে কাশ্মির দু’টুকরো করে দিল, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন করলো, বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির বানানো শুরু করলো সেই মোদিকে ট্রাক, লড়িতে চেপে দিল্লি এসে কৃষকরা চ্যালেঞ্জ করে বসবে! এটা হয়ত মোদির কল্পনাতেও ছিল না। একের পর এক রাজ্য দখলে বিজেপি যখন বেপরোয়া, এক ধরনের বিরোধীদলহীন রাজনীতির ফ্লেভারে ভারতের কৃষক আন্দোলন এটাই প্রমাণ করলো- যে কেউ বঞ্চিত হলে যেকোনো সময়ই প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

অনেকেই রাস্তায় আসছে দিল্লির দিকে। আটকে দিচ্ছে সরকার। পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা দিল্লির দিকে আসার পথে বিজেপি সরকার ও দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে। রায়ট কার, জল কামান ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই দিল্লির দিকে ছুটে আসছে হাজার হাজার কৃষকের আন্দোলনের স্রোত। যা থামানো যাচ্ছে না। এই কৃষক আন্দোলন শুধু ভারত নয় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি প্রান্তে কৃষক আন্দোলনের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে যে- ঐক্যবদ্ধ হলে কৃষকরাও ঘুরে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

ভারতে ৮৪ কোটি গ্রামীণ নাগরিকের ৫০ কোটিই কৃষক। গ্রামে বাস করে। কৃষিই তাদের একমাত্র আয়ের পথ। কৃষি ভারতীয় সংবিধানের যৌথ (কেন্দ্র, রাজ্য) তালিকায় থাকলেও এক্ষেত্রে কেন্দ্রের চেয়ে রাজ্যের অধিকারই ছিল বেশি। নতুন আইনের ফলে কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্বের নিয়ম রাজ্য সরকারের জায়গায় কেন্দ্রের আধিপত্য বাড়বে। কৃষি বাজারের উপর রাজ্যের একচেটিয়া প্রভাব আর থাকছে না। চাল, ডাল, গম, আলুসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম আগে নূন্যতম কত হবে এটা সরকার নির্ধারণ করে দিত। নতুন আইনের ফলে এই কাজটা বহুজাতিক সংস্থাগুলোও করতে পারবে। এতে কৃষকের বার্গেনিং পাওয়ার কমছে।

কৃষকরা বলছে- নতুন আইন তাদেরকে কর্পোরেট দাসে পরিণত করবে। যা কৃষকরা সহজভাবে নিতে পারছে না। এখন কৃষক নয়, বাজারই ঠিক করবে, কৃষক কত দামে তার পণ্য বিক্রি করবে। আর সেখানেই কৃষকদের আপত্তি। এজন্যই দিল্লিতে অবস্থান নিয়েছে কৃষকরা।

এখন শুধু পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরাই নয়, এদের সাথে যোগ দিয়েছে-কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, কেরালা এবং উত্তরাখন্ডের কৃষকরা। দিল্লির বুরারি ময়দানে গিয়ে রাজপথ ছেড়ে ওখানে গিয়ে আন্দোলন করতে বিজেপি সরকার চাপ দিলেই কৃষকরা রাস্তা ছাড়েনি। এখনতো যে পর্যায়ে আন্দোলন চলে গেছে সেখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই। মোদির জন্য এ এক কঠিন পরীক্ষাকৃষকরা ট্রাক লড়িতে করে দুই মাসের খাবার নিয়ে এসেছে। শীতের রাতে দিল্লির রাস্তায় ট্রাকে খড় বিছিয়ে ঘুমাচ্ছে আন্দোলনরত কৃষকরা। যে ছবি ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করছে আন্দোলনে।বিজেপি সরকার কখনো বলছে এ আন্দোলন খালিস্থানের স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাধীদের কাজ। কখনো বলছে কংগ্রেসের। কিন্তু এ আন্দোলন যে শুধু কৃষকদের দাবি আদায়ের তা অস্বীকারের আর সুযোগ নেই। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে দিল্লির দিকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষকদের ট্রাকের বহর।কৃষকরা স্পষ্ট করেই বলছে- নতুন তিনটি আইন বাতিল করে চতুর্থ একটি আইন প্রনয়ণ করলেই একমাত্র কৃষকরা দিল্লি ছাড়বে। এর আগে নয়।

ভারতের কৃষকের বিভিন্ন পণ্যের দাম ঠিক করে দেওয়ার সরকারি নীতি মিনিমাম সাপোর্ট পাইস বা এমএসপি নামে পরিচিত। প্রতি বছর সরকার এমএসপি ঠিক করে দেয়। এর ফলে কৃষকরা এত দিন পণ্যের একটি নূন্যতম মূল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু নতুন আইনে এই অধিকার বহুজাতিক সংস্থাকেও দেয়া হচ্ছে। ফলে কৃষকরা কৃষিতে কর্পোরেট খবরদারি মানতে পারছেন না। ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির ১৫% কৃষি নির্ভর। সুতরাং কৃষকদের দাবির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনও বাড়ছে। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ৮ ডিসেম্বর সারা ভারতব্যাপী পালিত হচ্ছে অবরোধ (বন্ধ) কর্মসূচী। আন্দোলন শুধু কৃষকদের মধ্যে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। কৃষকদের দাবি মেনে না নিলে এই কৃষক আন্দোলন যে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হবে এটা বলাই যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে কৃষক-শ্রমিক রাজনীতির একটা বড় প্রভাব অতীতে ছিল। একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়ায় কৃষকরাও কিভাবে রাষ্ট্রকে অধিকারের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে এমন ঘটনা নিকট অতীতে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে খুব একটা ঘটেনি।দক্ষিণ এশিয়া কৃষি নির্ভর। কৃষকই এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু কৃষকদের অধিকার বঞ্চনার স্লোগান এখন আর রাজপথে খুব একটা শোনা যায় না। ভারতের কৃষক আন্দোলনের পরিণতি কী হয় বলা যায় না, তবে এ আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনা এ অঞ্চলের প্রতিটি রাষ্ট্রের কৃষক আন্দোলনে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ