ভাস্কর্য ও মূর্তি

মিলন পাঠান
মিলন পাঠান  © টিডিসি ফটো

ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য দেখানোর কিছু নেই। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে অগণিত ভাস্কর্য আছে, সেসবের উদাহরণ দেবারও কোনো দরকার নেই। কেন নেই? কারণ, বাংলাদেশ পরিচালিত হয় সংবিধান ও পেনাল কোড দ্বারা। যে সংবিধান আমরা তৈরি করেছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তৈরি করেছেন। বাঙালিরা তৈরি করেছে।

এই সংবিধান তৈরি করার অধিকার কিভাবে এলো? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অধিকার অর্জিত হয়েছে। এই মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে? আমরা করেছি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা করেছে। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, যারা অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী, যারা ধর্মনিরপেক্ষকায় বিশ্বাসী, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী; যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী; তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে।

নেতৃত্ব কে বা কারা দিয়েছে? নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের অপরনাম বঙ্গবন্ধু। নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ(ভাসানী)-এর একাংশ, জাতীয় কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি।

বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অধিকার কিভাবে পেল? ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ট আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আরও অনেকগুলো দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। যেমন: জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, পিডিপি (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি), ডা: সংঘ, ন্যাপ(কং), পিএনএল (পাকিস্তান জাতীয় লীগ), কেএসপি (কৃষক শ্রমিক পার্টি), জেইউআই (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম), জাগণদল (জাতীয় গণতান্ত্রিক দল), এফএমএল এবং ন্যাপ (মোজাফফর)। এর মধ্যে একমাত্র ন্যাপ (মোজাফফর) মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নেয় নাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। উপরে সেই নামগুলো উল্লেখ আছে।

আরও অনেক উগ্রবামপন্থীরা বিরোধিতা করেছে, সেসব নাম আরেকদিন লিখব। অন্যরা সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেছিল। আবারও বলছি সক্রিয় ও সোচ্চারভারে বিরোধিতা করেছিল।

এই নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের একক নেতা এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেয়া হয় নাই। সংবিধান মানা হয় নাই। কেন? কারণটা সত্তরের নির্বাচনের মোনফেস্টোতে নিহিত আছে। যে মেনিফেস্টো তৈরি হয়েছিল ৬ দফা কর্মসূচীর আলোকে। যে কর্মসূচীর অনিবার্য পরিণতি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। যা হতে পারতো স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বেছে নেয় সহিংসতার পথ। আক্রমণের পথ বেছে নেয়।

বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সফল হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাঙালি সায় দেয়। বঙ্গবন্ধুর নামে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

সরকার গঠন ও মৃক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার অধিকার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমেই অর্জন করেছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ। বিজয় হয় বাঙালির। বিজয় হয় সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের। বিজয় হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের, বিজয় হয় অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার, বিজয় হয় গণতন্ত্রের, বিজয় হয় সমাজতন্ত্রের।

নির্বাচনে যারা পরাজিত হয়েছিল এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের পরাজয় হয়। শুধু ব্যক্তি বা দল নয়, তাদের রাজনৈতিক দর্শনও পরাজিত হয়ে। তাদের সকলকিছু পরাজিত হয়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বিজয়ীদের নিকট পরাজিতরা অপরাধী হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়।

ঠিক এই ভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংবিধান তৈরি ও প্রতিপালনের অধিকার অর্জিত হয়েছে। এই সংবিধান অনুসারে যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, যাদের রাজনৈতিক দর্শন পরাজিত হয়েছিল; তাদের কোন দাবি বা রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে কিছুই গৃহীত হবে না। সুযোগ নাই। ফলে তাদের রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী কোনটা ভাস্কর্য আর কোনটা মূর্তি এই নিয়ে আলোচনা বা ব্যাখ্যার ন্যূনতম সুযোগ নাই।
হিসাবটা বোঝা গেছে? বিষয়টা ক্লিয়ার হবার কথা এবার।

তাহলে এই নিয়ে তাদের করণীয় কিছু নাই? অবশ্যই করণীয় আছে। তাদের ইচ্ছে মতো দেশ চালাতে চাইলে সেটা করতে হবে নিজেরা ক্ষমতায় গিয়ে। চোরাগোপ্তা হত্যা, ফতোয়াবাজি , মানুষকে উস্কানী দেয়া, মাঝে মাঝে একটা-দুইটা সমাবেশ করার বদলে পারলে নিজেরা ক্ষমতায় যান। ক্ষমতায় যাবার জন্য নির্বাচনে অংশ নিন। জনগণের কাছে আপনাদের মেনিফেস্টো দিন। জনগণ ভোট দিলেই তবে ক্ষমতায় যেতে পারবেন।

আরও একটা পথ আছে। বিপ্লব করুন। ১৯৭১ সালে আপনাদের যে রাজনৈতিক দর্শনের পরাজয় হয়েছিল, সেই দর্শন সামনে রেখে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করুন। প্রয়োজনে যুদ্ধ করুন। নির্বাচন বা যুদ্ধে অথবা বিপ্লবে যদি আপনারা বিজয়ী হন তাহলে আমরা পরাজিত হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক দর্শনের পরাজয় মেনে নেব। আপনাদের যেমন খুশি দেশ চালাবেন।

যেমন খুশি আইন বানাবেন, দেশ চালাবেন। ব্যাস। এই, এটুকুই বলবার ছিল।

বি. দ্র.: বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার অপচেষ্টা করে কোন কোন রাজনৈতিক ইসলামের বণিকেরা। বিষয়টা অত সহজ নয় ভাইলোগ।

(ফেসবুক থেকে নেয়া)


সর্বশেষ সংবাদ