ওরা কি আর ক্লাসে ফিরবে?

কবে আবার এভাবে স্কুল যেতে পারবে তারা— প্রতীক্ষা সেই দিনের
কবে আবার এভাবে স্কুল যেতে পারবে তারা— প্রতীক্ষা সেই দিনের  © ফাইল ফটো

পাড়ার চায়ের দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। চায়ের অর্ডার দিতেই রুগ্ন শ্যামলা একটা ছেলে এসে চা দিয়ে গেল। হঠাৎ নতুন এই ছেলেটিকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম এই ছোটকু নাম কি? নাম মনির। এই দোকানে কখন কাজ শুরু করলি? এইতো কিছুদিন। তো লেখাপড়া করিসনা? সোজাসাপটা উত্তর, ক্লাস ফোর এ পড়তাম। লকডাইনে স্কুল বন্ধ। তাই ভাইয়া কাজে দিয়ে দিছে। এতটুকুর মধ্যেই ডাক আসল এই একটা চা দে। ছেলেটি তার কাজে চলে গেল।

ছেলেটির সোজাসাপ্টা এই উত্তর আমি সোজাভাবে নিতে পারলাম না। পরে দোকানদারের কাছে জানতে পারলাম ওর আব্বু অনেক আগে মারা গেছে। বড় ভাই রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। লকডাউনে স্কুল বন্ধ তাই ওর ছোট ভাইকে কাজে দিয়ে দিছে। এরকম হাজার মনিরের পড়ালেখার অবসান ঘটেছে এই মহামারিতে।

আজ প্রায় নয় মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেই সাথে বন্ধ শিক্ষার্থীদের লেখা পড়া। দীর্ঘ এই সময়টা লেখাপড়া থেকে বিরত থেকেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে লেখাপড়ার প্রতি অনীহা ভাব চলে এসেছে। এরপর আবার অটোপাশ। এইচএসসি পরীক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা না নিয়েই অটোপাশ দিয়ে দেওয়াতে অন্যান্য ক্লাসের যে ক’জন শিক্ষার্থী ন্যূনতম লেখাপড়া করছিল সে শিক্ষার্থীরা অটোপাশের আশায় তাও বিসর্জন দিয়েছে। লেখাপড়াবিমুখ হয়ে পড়েছে। ফলে মাঝ বয়সি অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কোন না কোনো কাজে লেগে পড়েছে। আবার অনেক দরিদ্র ঘরের মা বাবা পরিবারের খরচ মেটাতে না পেরে তাদের সন্তানকে উপার্জনের কোন কাজে দিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া অনেক মা-বাবা লেখাপড়া করানোর চাইতে তাদের সন্তানদের উপার্জনের মাধ্যম বানাতে পছন্দ করছে। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

আবার লকডাউনে বেড়ে গেছে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতা। এই প্রবণতার কারণ মূলত দুইটি। প্রথমত, এই সময়ের বিয়ের খরচ কম। আমাদের দেশে বিয়েতে কনে পক্ষকে বরযাত্রী খাওয়ানো বা যৌতুক নামের অপসংস্কৃতির বলির পাঠা হতে হয়। সাথে আছে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে বর পক্ষকে উপহার পাঠানো নামের আরেক খরচ। ফলে সাধ্যের বাইরে গিয়ে হলেও কনে পক্ষকে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। তাই লকডাউনকে এই খরচ বাচানোর একটি সুযোগ মনে করে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুল পড়ুয়া মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, যেসব অবিভাবকরা শুধুমাত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েদের পড়ায়। লকডাউনের আগে হয়তো মেয়ের জেদ, ইচ্ছা বা লেখাপড়ার চলমান একটা ধারা অব্যাহত থাকার দরুণ বিয়ে দেওয়া হয়নি। কিন্তু লকডাউনে এত লম্বা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে পড়াশোনর স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়ে ঘরে অবস্থান করায় মেয়ের অমতেই ভালো পাত্র পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আর লেখাপড়া সেটা তো বিয়ের পর করবে। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে বিয়ের পর এই শতকরা হার ভাবনায় ফেলে দেয়ার মতো।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিশ্বের শিক্ষা কার্যক্রম। একে ‘প্রজন্মগত বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) জাতিসংঘের ‘সেভ আওয়ার ফিউচার’ ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের ১৬০টি দেশের স্কুল বন্ধ রয়েছে। এতে ১শ’ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব পড়ছে। করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়ে আগামী বছর অনেক শিশু-কিশোরকে তাদের পড়াশোনায় ইতি টানতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গুতেরেস।

পুরো বিশ্ব এই মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগের সফলতা পাচ্ছে। হয়তো আমরা কার্যকরি ও যথোপযুক্ত প্রতিষেধক পেয়ে যাব। কিন্তু এই মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষাব্যবস্থার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পোষাবে কি করে। সরকারের জন্য এটি এখন বড় চ্যালেন্জ। যেসব শিক্ষার্থী এই দুর্যোগের শিকার হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে তাদের আবার স্কুলমুখী করতে যথাযথ পদক্ষেপ দরকার। সেইসাথে দীর্ঘসময় পড়ালেখা থেকে বিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে যে অনীহা তৈরি হয়েছে এবং যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে তার প্রভাব কাটিয়ে তুলে আবার সুস্থ মানসিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করার পরিবেশ তৈরি করাও কর্তৃপক্ষের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ