খুকি সংগ্রামী নারীদের প্রতিচ্ছবি

দিল আফরোজ খুকি
দিল আফরোজ খুকি

মলিন মুখ। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর। আবেদনময়ী চাহনি। সংগ্রামী জীবনযাত্রা আর মানবিক হৃয়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম দিল আফরোজ খুকি। বলছিলাম রাজশাহী মহানগরীর এক নারী হকারের কথা। যিনি প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা পায়ে হেঁটে নগরীর অলিতে-গলিতে খবরের কাগজ বিক্রি করেন।

আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরশীলতায় এই নারী হকার নীরবে হয়ে উঠেন এই অবহেলিত নারী সমাজের বিপ্লবী প্রতীক। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ যখন নারীদের কেবল ঘরবন্দী করে ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনের নতুন আসবাবপত্র, ঘর দেখভাল, সন্তান পালন আর ঘরের কোণে সিরিয়াল দেখে জীব অতিবাহিত করার আধুনিক দাসত্বের পথ সৃষ্টি করেছে।

ঠিক সেই সমাজে একজন নারীও যে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে এবং সমাজ পরিবর্তনের অংশ হতে পারে নীরব ভাষায় হাজারো প্রতিকূলতা মাঝে সেটা দেখিয়েছেন এই হার না মানা সংগ্রামী নারী হকার ‘দিল আফরোজ খুকি’।

মানসিক ভারসাম্যহীন ষাটোর্ধ এই সংগ্রামী নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেছে নারী স্বাধীনতার নির্মম চিত্র। উপলব্ধি করেছে মানসিক ভারসাম্যহীনদের জীবনযুদ্ধ। উপলব্ধি করেছে বুর্জুয়া বিলাসীদের দেয়া উচু-নিচু মতভেদ ও বেশভূষায় পরখ করে সম্মান করার ট্যাগ।

এই উপলব্ধি থেকে খুকি বলে থাকেন, ‘জন্ম নেওয়া সহজ, জীবন বড় কঠিন। জীবন একটি নৌকার মতো যাকে তার তীরের সন্ধান করতে হয়’। তাই শত অবহেলা এবং প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নীরবে সেই তীরের সন্ধান করেই চলেছেন সংগ্রামী এই খুকি।

অল্প বয়সে স্বামী হারানো এই নারী একাকিত্ব এই জীবনযুদ্ধে সমাজের তথাকথিত প্রচলিত সিস্টেমের কাছে বার বার হোটচ খেয়েছে। কেননা সে বদ্ধঘরে আবদ্ধ না হয়ে মুক্ত বাতাসে আর দশজন পুরুষের মতো নিজের যোগ্যতা ও কর্মপ্রচেষ্টা দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু সমাজের এই তথাকথিত সিস্টেমে ছিটকে পড়তে হয়েছে পরিবার থেকে। বঞ্চিত হতে হয়েছে পারিবারিক অধিকার থেকে। সমাজের পুরুষতান্ত্রিক লেলিহান লালসার শিকার হতে হয়েছে বারংবার।

কর্মসংস্থানের খোঁজে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কাজ পায় নি। বাদ্ধ হয়ে হকারির চাকুরি বেছে নিতে হয়েছে তাকে। খবরের কাগজ হাতে বিশ বছর বয়সী যুবতীকে দেখে যখন সমাজের বিকৃত মস্তিষ্কগুলো কুচ্ছা রটিয়েছে তখন মুখ বুঝে সহ্য করেছে খুকি। নীরবে ঘরের কোনে বসে হাউমাউ করে কেঁদেছে। অসুস্থ হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকেছে। কেউ দেখতে আসেনি!না খেয়ে কাটিয়েছে অনেক রাত। কেউ খেতে বলেনি! কেউ যদিও উপকারের কথা বলে হাত বাড়িয়েছেন। পরক্ষণেই অন্তরের বিকৃত সুপ্ত চাহিদা মেটাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছে!

কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর বিকৃত মস্তিষ্কগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ কর্মপ্রচেষ্টায় নির্ভীক চিত্তে সংগ্রাম চলিয়ে গেছে সে। সমাজের তথাকথিত সিস্টেমের বাঁধনে আটকে পড়েনি খুকি। অন্য আর দশজন নারীর মতো ঘরের ‘শো পিচ’ হয়ে থাকে নি সে। কেননা খুকি আর দশ জন পুরুষের মতো আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। সে তথাকথিত সমাজের এই সিস্টেম হতে বের হতে চেয়েছে। তাই তো তিনি বলেন, ‘আমি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি কখন যে নিভে যাব জানি না। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত জ্বলবো।’

কোনো কাজই ছোট নয়। অন্যের উপর নির্ভরশীল জীবনই বরং কষ্টের আখ্যা দিয়ে তিনি জানতে চান, আমি খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজের জীবন চালাচ্ছি, এটা কি অসম্মানের? এটা কিভাবে অন্য কারো সম্মানহানি করে?

আজ সে স্বাবলম্বী। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুঁলে নিজের পায়ে হেঁটে পত্রিকা ও বই বিক্রি করে যা রোজগার হয়। সেটা দিয়েই তার খেয়ে পড়ে দিন কেটে যায়। কার কাছে হাত পেতে সাহায্য নেয় না সে। বরং তার মতো কোন অভাগী অথবা দুস্থ মানুষকে দেখলে ততক্ষণাৎ পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সম্পদ বাড়িয়ে দেন খুকি। কেউ ইচ্ছে করে ফেরত দিলে নেয়। না দিলে কখন দাবি করেন না খুকি।

খোঁজ পেলে নিজ উদ্যোগে অসহায় নারীদের সেলাই মেশিন অথবা নগদ অর্থ ঋণ দিয়ে অন্যকোন ব্যবস্থা করে দেন তিনি। বিনিময়ে অতিরিক্ত কোন অর্থ কখনো দাবি করেন না। কখনো মিথ্যে বলেন না। আবার পথে-ঘাটে পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে লোকজনদের কখনও কখনও নিজ অভিজ্ঞতা, নৈতিকতা, মানুষের গুণাবলী নিয়ে এবং সক্রেটিস, গিরিশ চন্দ্র সেন এবং বেগম রোকেয়ার মতো মনিষীদের গল্প শুনান তিনি।

জীবন্ত এই সংগ্রামী কিংবদন্তির শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর পর তাকে যেন কুষ্টিয়ায় দাফন করা হয় এবং তার সম্পত্তি কুষ্টিয়া জেলা শহরের একটি স্কুল ও হাসপাতালে দান করা হয়।

আজকের এই দিল আফরোজ খুকি সংগ্রামী নারীদের প্রতিচ্ছবি। সমাজে তথাকথিত সিস্টেম নারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিবাদের জীবন্ত চিত্র। নারীর আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্বাবলম্বিতা অর্জনের বিপ্লবী প্রতীক। তাঁর ষাটোর্ধ এই সংগ্রামী জীবন লোক দেখানো প্রচলিত সামাজিকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং প্রেরণা।

কে এই সংগ্রামী নারী দিল আফরোজ খুকি

সংগ্রামী এই নারীর বাড়ি রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকায়। সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে খুকি দশম। আশির দশকে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশুনা করেছেন তিনি। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল, বিধবাও হয়েছিলেন কম বয়সেই।স্বামীর মৃত্যু শোকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন খুকি। বিপর্যয় কাটিয়ে নিজে স্বাবলম্বী হতে দ্বিতীয় বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন রাজশাহীভিত্তিক সাপ্তাহিক ‘দুনিয়া’ পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহমেদ শফি উদ্দিন সাপ্তাহিকের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। খুকির বোনের স্বামী আবদুল আজিজের অনুরোধে আহমেদ শফি উদ্দিন তাকে একটি চাকুরী দেন। কিন্তু করতে হবে হকারি! কেননা সেখানে তার অন্য কোন পদে কাজ করার সামর্থ কিংবা যোগ্যতা কোনটাই ছিল না।

বিষ বছর বয়সী এই যুবতী তখন লোক লজ্জা ভুলে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই কাজে। ২০ কপি দিয়ে শুরু করে সপ্তাহে ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করতে সময় নেননি তিনি। তার কাজের অভুতপূর্ণ সাফল্যের জন্য তাকে অফিস থেকে স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি শহরের অন্যান্য স্থানীয় দৈনিক বিক্রি শুরু করেন।’

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে খুকি শহরের পথে হেঁটে এভাবেই বিক্রি করছেন দৈনিক খবরের কাগজ। বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছে গেলেও তিনি এখনো সংবাদপত্র বিক্রি এবং পাশাপাশি সমাজসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। জীবনযুদ্ধের সংগ্রামী এই কিংবদন্তি 'নারী হকার' তার জীবনের বাকি সময়টুকু এভাবেই মানুষের পাশে থেকে কেটে দিতে চান।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়