২৬ অক্টোবর ২০২০, ১৫:১১

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রঙ

কার্জন হল  © ফাইল ফটো

আরবি এক লেখক বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মায়ের কোলের মত। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একজন শিশু তাঁর জীবনের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিজের মায়ের কোল থেকে শেখে। আর একজন প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থী তাঁর কর্ম জীবনের সাথে সব কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেখে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হালচাল দেখলে এর কার্যকারিতা কতটুকু তা একজন সচেতন নাগরিকের বোঝার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রের মত। এখানে জনগণ শিক্ষার্থী। প্রধানমন্ত্রী ভিসি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রক্টর। এভাবে অনেক কিছুকে তুলনা করা যায় দেশের সাথে। দেশের সরকারি দলের পরিবর্তনের সাথে শিক্ষকদেরও দল পরিবর্তন হয়। কেউ সাদা, আবার কেউ নীল। জানি না , অন্য কালারের কোন দল আছে কিনা। দেশের সরকারি দল পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায় বিভিন্ন দায়িত্বের শিক্ষকদের কাজ বা নাম। এখানেই অলিখিত সংবিধান, সরকারি দলের শিক্ষকদের সব যোগ্যতা রাখে। আবার ভিসি পরিবর্তনের সাথেও সরকারি দলের লোকদের ক্ষমতারও অনেক পরিবর্তন হয়। বিরোধী মতের শিক্ষকদের শুধু অধ্যাপনার যোগ্যতা আছে। সুযোগ পেলে অনেক সময় বিরোধী মতের শিক্ষকদের চাকরিও হজম করা হয়।

অনেকে এক সময় এক দল করলেও ক্ষমতার পালা বদলে তাদের আদর্শ বা দলও পরিবর্তন হয়। আর এই পরিবর্তন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। কারণ, এই সরকারই টানা ৩ বার ক্ষমতায় আছে। তাই, এক কালের ছাত্রদল বা শিবির করা শিক্ষার্থীও এখন কঠিন আওয়ামীলীগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে। যেই লোক একসময় আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতে পারতো না, সেই এখন জয় বাংলার জিকির করছে মুখ ফাটিয়ে। আবার এরাই সুযোগ পেলে দলের প্রতি তাঁর বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য শিক্ষার্থীর ওপর চালাচ্ছে অবিচার। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদের জন্য তোষামোদীর চাষ করা হয় উন্নত পদ্ধতিতে।যেন সবার উপরে তোষামোদিই সত্য। এনিয়ে জাফর ইকবাল স্যার লিখেছিলেন, মহব্বত আলীর একদিন আর আহমদ ছফা লিখেছিলেন গাভী বৃত্তান্ত।

এমন এক বাস্তব ঘটনার বিবরণ দেয়া যায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। কয়েক বছর আগের কথা। এক শিক্ষার্থী হল অফিসে যায় প্রবেশপত্র তুলতে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের এক শ্যিক্ষার্থী ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে ঐ শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালায়, শিবির আখ্যা দিয়ে। কিন্তু ভুল করে তাঁর বন্ধু হিন্ধু শিক্ষার্থীকেও মারে। পরে ভিসি স্যারকে হিন্দু শিক্ষার্থী মারার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, হিন্দু শিক্ষার্থী ছাত্রদল করে। কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ নয়। তারা মেরে শিক্ষার্থীর দামী স্মার্ট ফোন হস্তান্তর করে হল প্রভোস্ট বরাবর। পরে এই শিক্ষার্থী ফোন আনতে হল প্রভোস্টের কাছে গেলে তিনি ফোন দিতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে বলেন , সে দেশ বিরোধী দল করে। আমাকে জানানোর পর আমি স্যারকে ফোন দিলে তিনি বলেন, সে শিবির করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার কাছে প্রমাণ আছে? তিনি বললেন, সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন বলেছে। আমি তারপর বললাম, ক্যাম্পাসেতো সব রাজনীতি নিষিদ্ধ।এবার তিনি চুপ থাকলেন।আর বললেন, তাকে পাঠিয়ে দিও, মোবাইল দিয়ে দিব।

এভাবে অনেক ঘটনা নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে বিরোধী মতের বা বিরোধী মতের ট্যাগ খাওয়া শিক্ষার্থীরা। গত কিছুদিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেইসবুকে এক কমেন্টকে কেন্দ্র করে তাকে সাময়িক বহিষ্কার ও প্রোক্টর এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে মামলা করায় আইসিটি আইনে। এমনকি জানতে চাওয়া হয়েছে কেন স্থায়ী বহিস্কার করা হবে না? তবে অনেকের বক্তব্য এখানেও এক শিক্ষক আছেন, যিনি এক কালে বিএনপি জামাতের লোক ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে প্রো-ভিসি হওয়ার দৌড়ে নিজেকে এগিয়ে নিতে এই শিক্ষার্থীকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে, সবাই যেন ভাবে তিনি আসলেই আওয়ামী লীগ করে বা করেন।

কিন্তু বর্তমান যুগ অনলাইনের যুগ। তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা খুবই সহজ। তাই এই হাইব্রিড লোকদের মতি গতি অনেকে অনুসরণ করছে। সংগ্রহ করছে তথ্য প্রমাণ। তারাও সময়ের পরিবর্তনে এই তথ্যগুলোকে টার্মকার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে। আর ঐসময়ে সরকার পরিবর্তনের সাথে দল পরিবর্তন করা এত সহজ হবে না।

এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোকে প্রয়োগ করা হচ্ছে বিরোধী মতের ওপর। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন, হত্যা, ইভটিজিং , টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী ,নারী কেলেংকারী ও অর্থ কেলেংকারী করে স্থায়ী বহিষ্কার হয়েও জেল খানায় বসে পরীক্ষা দেয়ার কথাও শোনা যায়। যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো কিতাবে আছে জমিনে নাই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আমাদের অভিভাবক বা জনগণের চিন্তা ভিন্ন ও সাদাসিদে।তারা মনে করেন এখানে যারা পড়ান তারা জাতীর অভিভাবক। তারা মনে করে এখান থেকে বের হবে একজন সৎ, সাহসী ও আদর্শ মানুষ। হবে সোনার মানুষ আর গড়বে সোনার বাংলদেশ । কিন্তু এখানে হচ্ছে খুন, ধর্ষণের সেঞ্চুরি, শিক্ষক লাঞ্চনা ও শিক্ষিকা ইভটিজিং সহ নানা অপকর্ম। এনিয়ে সবাই হতাশ।

তবে হ্যাঁ, এরপরও কিছু শিক্ষক আছেন। যারা নীরবে অধ্যাপনা করে যাচ্ছেন। যদিও তাদের তেমন কোন পদ নেই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে রয়েছে তাদের জন্য আন্তরিকতা ও ভালোবাসা। এভাবে চলতে থাকলে, বিশ্ববিদ্যালয় হবে ভুরি ভুরি, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তন হবে। শিক্ষিতও বাড়বে। জাতির ভাগ্য কোন পরিবর্তন হবে না। দুর্নীতিবাজের জায়গায় আবার দুর্নীতিবাজ প্রতিস্থাপন হবে।আর আমাদের দেশ যাবে রসাতলে। আর মানুষ দেখতে যেতে হবে যাদুঘরে।

লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।