সেশনজট, অনলাইন ক্লাস ও বাস্তবতা: একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা

মো. ওমর ফারুক
মো. ওমর ফারুক  © টিডিসি ফটো

আসসালামু আলাইকুম। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী ও বিভাগের সকলকে জানাই শুভেচ্ছা। আশা করি সবাই ভালো আছেন, করোনাকালে সুস্থ আছেন। আমি ভালো নেই, আমি হতাশাগ্রস্ত, আমি বিপর্যস্ত। অন্যদের কথা আমি বলব না। আজ বলবো নিজের কথা, নিজের সংগ্রামের কথা, ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা।

বিভাগে শিক্ষার্থী হিসেবে আপনাদের সান্নিধ্যে আসি ২০১৫ সালের জুনে ৬ মাসের সেশনজট মাথায় নিয়ে এখানে এসেছি। (অবশ্য এ সেশনজট আমার নিজের জন্য, আমি এখানে ভর্তি না হলে এই জটের ভাগিদার হতে হতো না)। এখন ২০২০ সালের শেষ হওয়ার দিকে। এখনো অনার্স শেষ করতে পারিনি।

যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই সেশনে ভর্তি হওয়া জটে থাকা হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগ ব্যতীত সবাই অনার্স শেষ করেছে। এমনকি কারো কারো মাস্টার্সও শেষ, কারো শেষের দিকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ও দুঃখজনক বিষয় হলো ২০১৫-১৬ সেশনেরও কিছু কিছু বিভাগ অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছে। আমাকে দেখে টিটকারি দেয়, তখন আমার মনের অবস্থা কেমন হয় একবার ভাববেন।

অনলাইন ক্লাস প্রসঙ্গ

এ বছরের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ ২৫ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবরুদ্ধ হয়। এতে আর একদফা সেশনজটে পড়ি। তবে এটি আমাদের জীবনের সাথে জড়িত। এটি সারাবিশ্বে সবার ক্ষতি করেছে, শুধু যে শিক্ষায় তা না, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সবক্ষেত্রেই।

করোনাকালে সৃষ্ট এই জট নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার করোনাকালে সৃষ্ট শিক্ষায় ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ভার্চুয়াল ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়েও আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীরা পাঠদান শুরু করেন।

অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার মতো গতিশীল বিভাগে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে কোন উদ্যোগই নেই। ভবিষ্যতেও শুরু করার ব্যাপারে কোন সদিচ্ছা আছে, এটার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিভাগে অনলাইনে পাঠদান চলমান, যা আমাদের জন্য চরম হতাশার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেনীতে পাঠদান শুরু, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ম সেমিস্টার অনলাইনে শেষ হয়ে ৮ সেমিস্টার শেষের দিকে (অথচ সেখানে ১ দিনের জটও নেই), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে পাঠদান চলমান, সব বিশ্ববিদ্যালয়ই কোন না কোনভাবে তার শিক্ষার্থীদের হতাশা মুক্ত করার পথ তৈরি করেছে।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পর্যন্ত পাঠদান শুরু হয়েছে, এখন সর্বশেষ মাধ্যমিক ও সমমান প্রতিষ্ঠানগুলোর পেজে বাধ্যতামূলক ক্লাস আপলোড শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাতে সাড়াও দিয়েছে।

বাস্তবতা

আমি ওমর ফারুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগের পথটাও এতোটা সহজ ছিলো না। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষিকাজ, দিনমজুরী, টিউশনি কোনো কাজই বাকি রাখি নাই। একবার পড়াশোনা বন্ধ হতে লাগলেও হাল ছেড়ে দেই নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় বছর জীবনে বাড়ি ছয় পয়সা ও নিজর খরচের জন্য নেই নি। উপরন্তু এই কয়েক বছরে টিউশনি করে প্রায় ৪-৫ লক্ষাধিক টাকা বাড়িতে দিয়েছি।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাবা-মা দুজনেই একসাথে অসুস্থ হয়। টানা দড়ে বছর ট্রিটমেন্ট করানোর পর, একটা অপারেশেনের মধ্যদিয়ে আমার মা আল্লাহর রহমতে এখন সুস্থ। সবমিলে হিসাব করে দেখলাম মার ট্রিটমেন্টের জন্য দুই লাখ খরচ হয়।

কিন্তু আমার বাবা এখনো অসুস্থ। মাসে দুই বার করে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়। প্রত্যেক মাসে বাবার ট্রিটমন্টের জন্য দশ হাজারের মতো খরচ লাগে। চিকিৎসা খরচ পুরোটাই আমি বহন করতেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমি ইনশাআল্লাহ সব ঠিকমতো করতে পারতাম। এখন আমার নিজেরই চলার মতো কোন উপায় নেই। তাহলে বাবা মায়ের চিকিৎসা খরচ বহন করবো কীভাবে? বাবা মা দুইজনেরই ভারী কাজ করা নিষেধ। এমতাবস্থায় আমার অবস্থা কেমন হতে পারে তা যদি একবার ভাবতে পারতেন, তাহলে এই সেশনজট কোনদিন তৈরি হতো না।

এই জট কোনদিন পূরণ করা সম্ভব নয়, সেটা আমি জানি। আবার করোনা না আসলে এতো জট তৈরি হতো না সেটাও আমি জানি। অতি অল্প সময়ে বিভাগ স্নাতকোত্তর শেষ করে দেই, সেজন্য আমার নিজেরও ব্যক্তিগতভাবে জট নিয়ে কোন সমস্যা তৈরি হয়নি।

কিন্তু এখন আর সেটা সহ্য সীমার মধ্যে নেই। ৭ মাস অলস বসে আছি, অন্তত একটা সেমিস্টার যদি ভার্চুয়ালি পাঠদান শেষ হতো, তাহলে কমপক্ষে ৬ মাস আমাদের সময় বেঁচে যেতো। পড়াশোনা শেষ করতে যদি ২৭ বছর লাগে, তাহলে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে কখন নামব?

‘বাবা মা মারা গেলে কার জন্য যুদ্ধ করবো?’ আপনাদেরও তো বাবা মা আছে। একবার নিজেদের অবস্থান থেকে আমার কষ্টগুলো অনুভব করার অনুরোধ রইলো।

বিভাগের প্রতি আকুল আবেদন, স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করুন। সেটি সম্ভব না হলে অতিসত্বর অনলাইন পাঠদান শুরু করে আমাকে হতাশা থেকে মুক্ত করুন। আমাকে বাঁচার সুযোগ করে দিন, বাবা মায়ের জন্য কিছু করার ক্ষেত্রটা তৈরি করতে দিন।

আমাদের নিয়ে আপনাদের ভাবনাগুলো গ্রুপে শেয়ার করেন। এমসিজে কে ফ্যামিলি বলা হলেও ফ্যামিলির অভিভাবকগণ টানা ৭-৮ মাস ফ্যামিলির সদস্যদের কোনো খোঁজ খবর রাখেন নি। এসব আমার নিজস্ব অভিমত। আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে সন্তান হিসাবে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ আপনাদের সুস্থ রাখুন সুন্দর রাখুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, (২০১৪-১৫ সেশন) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ