গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থা রাজনৈতিক জাঁতাকলে পিষ্ট
গ্রাম আদালতের বাইরে পল্লী অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কমবেশি সালিশি ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারির ঘটনাও মীমাংসা হয় এ সালিশের মাধ্যমে। দিনে দিনে সেই গ্রাম সালিশি ব্যবস্থায়ও ঢুকে পড়েছে পক্ষপাতিত্ব, রাজনীতি ও অবৈধ অর্থের লেনদেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতেও চলছে বিচারের নামে প্রহসন। ধর্ষণের মতো ঘটনাও ভিন্ন খাতে নেওয়া হচ্ছে। ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। আর বেড়ে যাচ্ছে অপরাধের মাত্রা। বেপরোয়া হয়ে উঠছে দুর্বৃত্তরা।
নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন ও সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের মতো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এরকম বহু ঘটনা সমাজপতিরা ঘটিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। তারা নির্যাতনকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতাদেরকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে সমাজের প্রতিনিধিরা যদি সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন, তাহলে নির্যাতনকারীরা অন্যায় করার আগে ভাবত যে, অন্যায় করে সমাজে পার পাওয়া যাবে না।
সমাজে আজ ‘ভিলেজ পলিটিক্সে’র জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গ্রামে সালিশ আগের তুলনায় অনেকটা ভিন্নরূপ ধারণ করেছে।
ভিলেজ পলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। এমনকি অনেককে গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে আজ কোণঠাঁসা প্রবীণরাও। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই উল্টো বিপদে পড়তে হয় পদে পদে। নিরীহ মানুষ এমন ভোগান্তির শিকার।
নিষ্ক্রিয় গ্রাম আদালত : ২০১৬ সালে গ্রাম আদালত কার্যকর হয়।
প্রচলিত আদালতে মামলাজট কমাতে এই গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। দেশের চার হাজার ৫৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে এক হাজার ৮০টিতে নিয়মিত গ্রাম আদালতের কার্যক্রম চলে। এই আদালত সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। এই আদালতের এখতিয়ারে রয়েছে- চুরি, ঝগড়া, প্রতারণা, ভয়ভীতি দেখানো, নারীকে অমর্যাদা করা, পাওনা টাকা আদায়, গবাদিপশুর ক্ষতির মতো বিরোধের নিষ্পত্তি কার্যক্রম।
গ্রাম আদালতকে সক্রিয় করতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় প্রকল্প নেওয়া হয়। গ্রাম আদালতের প্রধান হলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সঙ্গে থাকে পাঁচজন ইউপি সদস্যের একটি প্যানেল।
বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। অনেক ক্ষেত্রে সালিশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সালিশের নামে ফতোয়া প্রদানের কারণে নতুন করে বড় বিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র ও অবহেলিতরাই বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন
আসকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে সালিশ ও অবমাননাকর ফতোয়ার ঘটনায় ১০ নারী নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু অবৈধ এ সালিশকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়নি।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির কারণে গ্রাম আদালত মূল বৈশিষ্ট্য থেকে সরে যাচ্ছে। হত্যা, ধর্ষণ, বড় ধরনের ডাকাতি, দখলসহ মারাত্মক অপরাধগুলোর বিচার ও নিষ্পত্তি গ্রাম আদালতের কাজ নয়। কিন্তু অনেক স্থানে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গ্রাম আদালত এ ধরনের বিচারও করছে, যা দণ্ডনীয় অপরাধ। গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তগুলো নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হচ্ছে কিনা, তার তদারকি থাকতে হবে।
থানাতেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা : অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো এড়িয়ে যায়। আদালতে মামলা চালানোর ভয়ে অনেকেই আদালতে যেতে চান না। পাশাপাশি গ্রামের ‘টাউট বাটপাড়’ এক শ্রেণির লোকের খপ্পরে পড়ে কেউ কেউ আদালতে না গিয়ে গ্রাম্য সালিশের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েন।
গ্রামগুলোতে সমাজপতি আর অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক আছে। নারী নির্যাতনের ঘটনাকে পুলিশ খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চায় না। পুলিশ কর্মকর্তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুলিশ স্টাফ কলেজের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, থানায় যাওয়ার পর থেকে নারী ও শিশুরা বিচারের প্রতিটি ধাপে প্রতিবন্ধকতার শিকার হন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সমাজকর্মী।