আমার এইচএসসি পাসের আনন্দ
- কাজী তাহমিনা
- প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৮:২৩ PM , আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৮:২৩ PM
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় একবারে পাশ করেছি- এর চেয়ে বড় আনন্দের ঘটনা আমার জীবনে আর মাত্র দুএকটি ঘটেছে।
আগে একটু ইতিহাস বলে নিতে হবে।
আমি ক্লাস নাইন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছি-সাহিত্য পড়বো -ইংরেজি সাহিত্যই পড়বো। কলেজে উঠে মানবিক বিভাগে পড়তে চাইলাম -কিন্তু আমার আব্বু আমাকে ডাক্তার বানাবেনই, তাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে বাধ্য হলাম।
কিভাবে সংগ্রাম করে আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্বপ্নের ইংরেজি সাহিত্যেই পড়েছি এবং তারপর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, সেটা আরেকদিনের গল্প।
তো, বিজ্ঞানে অজ্ঞান আমি ভাবলাম, আমাকে জোর করে বিজ্ঞান পড়ানোর জেরে আব্বুকে একটা জোর শিক্ষা দেয়া দরকার।
আব্বুকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে বিবাগী হয়ে গেলাম। মনের আনন্দে কলেজ যাই, ঘুরি ফিরি, আড্ডা দিই, হাহা হিহি করি, ক্লাস পালিয়ে মাঠে বসে ঘাস ছিঁড়ি,আকাশ দেখি, ফাঁকা ক্লাসরুমে টেবিল চেয়ার বাজিয়ে গান গাই, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লিটারালি আকাশ কুসুম কল্পনা করি, ভরসন্ধ্যায় মন উদাস ভাব নিয়ে নিয়ম করে 'পিয়া বাসান্তিরে এ এ,কাহে সাতায়ে, আ জা আ আ'সহ নানাবিধ প্রেম-বিরহের গান শুনি এবং উড়ু উড়ু মন নিয়ে নানারকম দিবাস্বপ্ন দেখি।
এবং এসব করতে গিয়ে পড়ালেখাকে শিকায় তুলে রাখলাম। ফলস্বরূপ, বান্ধবীরা আমরা সবাই মিলে প্রতি টার্মে ফেইল করার প্রায় মহোৎসব বাঁধিয়ে বসলাম!
ভিকারুন্নিসার ইতিহাসে এক কলঙ্ক হিসাবে আবির্ভূত হয়ে, পাঁচ টার্মের ভেতরে তিন তিনটি টার্মে ৬ বিষয়ের ভেতর ৩ বিষয়ে ফেইল করার দায়ে তিন তিনবার গার্ডিয়ান নিয়ে যাওয়া লাগলো। প্রথমবার খালাতো বোনকে বড়বোন বানিয়ে নিয়ে গেলাম, দ্বিতীয়বার মামীকে নিয়ে পার পেলাম। তৃতীয়বার মানে টেস্টে রেকর্ড পরিমাণ খারাপ নাম্বার নিয়ে ফেইল করার কারণে আম্মাকে নিয়ে বন্ডসাইন দিয়ে বোর্ড পরীক্ষায় বসার অনুমতি পেলাম।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত কোন ক্লাসে আমি দ্বিতীয় হইনি, সবসময় প্রথম হয়ে, ৯০২ নাম্বার নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করেছিলুম। আর একটু হলেই স্ট্যান্ড করে বসতাম, আর কি!
তো সেই আমি, টেস্ট পরীক্ষায় অংকে ৭৫ এ ০৬ পেয়ে অংকের আম্বিয়া আপাকে হতবাক করে দিয়ে, নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। বোর্ড পরীক্ষায় একবারে পাশ না করলে নিজে তো পস্তাবোই, আর আব্বু হার্টফেইল করে মারাও যেতে পারে।
তো আব্বুকে বাঁচানো এবং একবারে পাশ করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তিনমাস ধরে বেধড়ক পড়াশোনা শুরু করলাম। তখন বই খুললেই আমার 'পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে' অবস্থা! ফিজিক্স পড়ি, না কেমিস্ট্রি- ক্যালকুলাস করি, না গলায় দড়ি দিয়ে মরি-ভাবতে ভাবতেই পরীক্ষা চলে আসলো। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে মোটামুটি ভালোই একখানা ব্রেইন দিয়েছিলেন, তার কল্যাণে নিজেকে পর্যন্ত অবাক করে দিয়ে, কিভাবে কিভাবে যেন বেশ ভালোই একখান রেজাল্ট নিয়ে একবারে আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ফেললাম!
মনে আছে, রেজাল্ট দেখে আমি আর পলি মনের আনন্দে-একবারে পাশ করার আনন্দে সারা কলেজ ঘুরে ঘুরে নাচানাচি করেছিলাম।
কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে রেজাল্টের দিন পর্যন্ত একটা রাত আমি দুঃস্বপ্ন না দেখে কাটাইনি। এখনো মাঝেমাঝে সেই একই দুঃস্বপ্ন দেখে আমি ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠি। দেখি যে, আমার ফিজিক্স পরীক্ষা -প্রশ্ন দিয়েছে কেমিস্ট্রির; দেখি, ফিজিক্স পরীক্ষা -একটা প্রশ্নও কমন পড়েনি! এখন মাঝেমাঝে দেখি, অনার্স,মাস্টার্স শেষ-সার্টিফিকেট দিচ্ছেনা -কারণ ইন্টারের ফিজিক্স পরীক্ষায় পাশ করা এখনো বাকি!
তারপর হন্তদন্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে মনে পড়ে, যে আমার এই জীবনে আর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে হবেনা, সম্ভবত আর কোন পরীক্ষাই দিতে হবেনা- কারণ আমি একবারে এইচএসসি পাশ করে ফেলেছি!
কি যে শান্তির একটা অনুভূতি হয়, কোনদিন কাউকে বোঝাতে পারবোনা।
প্রতিবার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন অনেক আনন্দ লাগে আমার- ২০০১ এর ফাঁড়া এ জীবনে ইনশাআল্লাহ আর আসবেনা!
এতো কথার আসল কথা হইলো, এসএসসিতে ৯০২ পেয়েছি, কারণ লাগাতার অমানবিক পড়া পড়েছি। এরপর, পড়ালেখা দুইবছর শিকায় তুলে রেখেছি। টেস্টের পরে আবার ব্যাপক পড়াশোনা করেছি।
তো, এসএসসির রেজাল্ট এর উপরে ভিত্তি করে দিলে আবারো গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাই, কিংবা টেস্ট প্রিটেস্টের রেজাল্টের উপরে ভিত্তি করে দিলে ফেইল করি। দুটোর কোনটাই আমার এইচ এসসির পড়াশোনার আসল মূল্যায়ন করেনা।
দুইটা পদ্ধতিই ভুয়া। ভুয়া দি গ্রেট। পিরিয়ড!
লেখা: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত