এইচএসসি নিয়ে যত মাথাব্যথা এবং আমাদের অবস্থান
প্রথম আপত্তি: সব চলমান তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন? করোনা কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই? জবাবে বলব, না ভাই। করোনা সবখানেই আছে কিন্তু শিক্ষাখাত প্রত্যক্ষভাবে জীবিকা উপার্জনের পথ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতি সাপেক্ষ পড়াশোনা ছয় মাস বা এক বছর বন্ধ থাকলে মানুষ মরবে না। বাড়িতে একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কিংবা প্রযুক্তির সহায়তায় কমবেশি পড়াশোনা সম্ভব এবং এমনটা ঘটছেও।
কিন্তু বাঁচার জন্য নিয়মিত খেতে হয়, এজন্য নিরুপায় হয়ে উপার্জনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো অনেকটা জোর করেই আমরা স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছি। যদিও প্রকৃত পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।
উপরোক্ত প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের সমস্যা অন্য জায়গায়: ১. আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামব আর শিক্ষকরা বাসায় বসে বসে বেতন পাবে? এটা মানা যায় না। ২. বাসায় বা এলাকায় থাকতে থাকতে একঘেয়েমি, বাড়ন্ত খারাপ লাগা। ৩. পারিবারের অর্থনৈতিক বিষয়সহ বিভিন্ন কারণে মানসিক অশান্তির সৃষ্টি বা অস্বস্তি বৃদ্ধি।
অপরিহার্যতা সাপেক্ষে শিক্ষার অচলাবস্থা বজায় রাখা এবং এসব আপত্তির প্রতিকারের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সম্ভব, তা আমরা জানি না। তবে হ্যাঁ, দেহে প্রাণ থাকলে আপত্তির প্রতিকার একটু দেরিতে হলেও হয়ত যায়-আসবে না।
দ্বিতীয় আপত্তি: উপার্জনের জন্য পরিবারের যে সদস্য বাইরে যায় তার মাধ্যমেও তো করোনা আক্রান্ত হতে পারি। এছাড়া শিক্ষার্থীরাও তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। জবাবে বলব যে, রাষ্ট্রীয় আদেশে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে পড়ার পর করোনাক্রান্ত হলে খুব স্বাভাবিকভাবে ট্যাগিং হবে স্কুল খোলার এতদিনে এতজন শিক্ষার্থী করোনার শিকার এবং এর দায়ভার রাষ্ট্রের (আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি, এটাই বহির্বিশ্বে ঘটছে)।
সন্তানের কিছু হয়ে গেলে বাবা-মা রাষ্ট্রকে প্রবলভাবে দোষারোপ করবে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং অনুশাসন হুমকিতে পড়বে। কিন্তু শিক্ষার্থী অনানুষ্ঠানিকভাবে আক্রান্ত হলে এর দায়দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীর নিজের কিংবা তার পরিবারের। এই বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
তৃতীয় আপত্তি: স্বাস্থ্যবিধি মেনে এইচএসসি নিলেই তো হয়। জবাবে বলব, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে ১৩-১৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলা খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
কিছু উল্লেখযোগ্য আপত্তি হল— যারা পরীক্ষা চলাকালীন আক্রান্ত হবে বা মারা যাবে, তাদের ব্যবস্থা কি হবে? হলের কেউ আক্রান্ত হলে বাকিদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হবে? কয়জন পরীক্ষার্থী নিজস্ব পরিবহনে যাবে? অধিকাংশই যাবে গণপরিবহনে। হাত স্যানিটাইজ করাবেন হলে ঢুকতে, কিন্তু যাওয়া-আসার সময়? কতটুকু দূরত্ব বজায় রেখে হলে সবাইকে প্রবেশ করাবেন বা বের করাবেন? বিষয়টি কি আদৌ যথোপযুক্ত হবে?
চতুর্থ আপত্তি: অতিরিক্ত ছয় মাস পেয়েও পরীক্ষা দিতে আপত্তি কেন? প্রত্যুত্তরে বলতে চাই, ইয়েলো জার্নালিজমের কারণে এখন পর্যন্ত আমরা সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা অস্থিতিশীলতায় ভুগছি। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে শিক্ষা সংক্রান্ত হাজারো ছয়-নম্বরি খবরাখবরে আমরা প্রচন্ড মানসিক অশান্তির শিকার।
অবশ্যই পরীক্ষার্থী হিসেবে আমাদের একটু বেশিই দুশ্চিন্তা ছিল। ফলে অন্তত এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত আমরা আপনাদের মতই আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। তবে আপনারা-আমরা অনেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছি, করছি কিন্তু কাঙ্ক্ষিতভাবে নয়। তবে এই সামগ্ৰিক দিক বিবেচনায়, পরীক্ষা দেবার মানসিক প্রস্তুতি এই মুহূর্তে নেই। এরপরও যদি এ নিয়ে কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমরা আপনাদের মত মানুষ না, ভাই আমরা এলিয়েন।
পঞ্চম আপত্তি: যদি করোনা থেকেই যায় তাহলে কি এইচএসসি হবেই না? হবে ভাই। তবে যতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কোনো মৌলিক ক্ষতি নেই ততদিন অপেক্ষা করতে আপত্তি কিসের? স্বাভাবিক সময়েও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম শেষ হতে হতে মার্চ মাস এসে যায়। তো পরীক্ষা যদি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও হয় আমাদের সেশন মোটামুটি ঠিক সময়েই শুরু হবে। আর যদি কোনোভাবেই সম্ভব না হয়, বিজ্ঞ মন্ত্রণালয় তো বিকল্প ভাবছেই, এসব তাদের এখতিয়ারাধীন।
এখন আসি ষষ্ঠ আপত্তিতে: কিন্তু এই আপত্তিটা আমাদের পক্ষ থেকে। যেহেতু চলতি বছরের এইচএসসি ব্যাচের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তাই আমাদেরকেই বলির পাঁঠা বানানোর নিছক অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
অনলাইন নিউজপোর্টালে অনেকের মন্তব্যে এটা স্পষ্ট যে- ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টটা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দিয়ে চলুক, দেখা যাক পরীক্ষা চলাকালীন কি কি ঘটে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য স্তরের শিক্ষার্থীদের কোনো যৌক্তিক গতি হয় কি-না (অবশ্য এর বিরুদ্ধবাদীদের সংখ্যাও কম নয়)।
বিচার-বিবেচনায় ত্রুটি থাকলে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু এটুকু বলতে চাই, একটি রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন সেক্টরে সমন্বয় করা খুবই কঠিন বিষয়। সেখানে এমন প্রতিকূল পরিবেশে বিষয়টি আরও কয়েকগুণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। কর্তারাই জানেন, তারা কতটা চাপে আছেন! আশা করি, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও তার বিজ্ঞ পরিষদ আমাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেবেন। ধন্যবাদ।
লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী, শঠিবাড়ী মহাবিদ্যালয়, রংপুর