শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা
১৯৬৮ সালে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ বি এ (অনার্স) শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তখন আমি তাকে ছাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। আমাদের ব্যবস্থায় শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রী বেছে নেন, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক বেছে নিতে পারে না। এখন অনেক বিকল্প পঠন পাঠনের ব্যবস্থা থাকায় কোনো কোনো শিক্ষককে এড়িয়ে যাওয়া যায়। তখন এমন সুযোগ ছিল না। সুতরাং আমি যে হাসিনার শিক্ষক বনে গেলাম, সে দোষ তার নয়, দোষ তার ভাগ্যের।
সেটা ছিল এক ঝোড়ো সময়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে সরকারিভাবে নানা তোড়জোড় চলছে চারিদিকে। এদিকে তার অপশাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ফুঁসছে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ বলে আখ্যায়িত ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন। তার প্রতি মানুষের সাড়া ক্রমাগত বাড়ছে। ১৯৬৮ সালে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। অল্পকাল পরেই তাঁকে প্রধান আসামি করে রুজু করা হয় দেশদ্রোহমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। পূর্ব বাংলায় শুরু হয় অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান। তার চাপে শেখ-মুজিব মুক্ত হন, জনগণ তাঁকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়, আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়।
তখন ক্লাসের শেষে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হতো তাদের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে, শেখ মুজিবের কুশল সম্পর্কে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। আশা-নিরাশার দোলায় অনেকদিন কাটবার পর আমরা আনন্দের সন্ধান পাই।
তারপরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যাই। শেখ হাসিনার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আপাতত স্থগিত রাখে।
তার সঙ্গে আবার যখন সাক্ষাৎ হয়, ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ঘটে গেছে। দীর্ঘকাল প্রবাসজীবন যাপনের পর সে স্বদেশে ফিরে এসেছ। চট্টগ্রামে গিয়েছিল দলীয় কর্মসূচিতে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছে। আমি গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছি।
তারপর সে যাই করেছে, তা হয়ে গেছে ইতিহাসের অঙ্গ। স্বৈরাচারী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা, বিরোধী দলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করা, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে সফল আন্দোলন করা, প্রধানমন্ত্রী হওয়া। তার ওপরে আবার বিরোধী দলের নেত্রী, ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তা এবং আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হওয়া।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে শেখ হাসিনার তিনটি সাফল্যের কথা বলতে পারা যায় : খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, গঙ্গার পানিচুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা। এবারে প্রধানমন্ত্রীর আসনে স্থির হয়ে বসতে না বসতেই বিডিআরের ঘটনা। এই দুঃখজনক অধ্যায়টিও সে বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে।
দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা তার কাছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রে এবং ফলে গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করবে, এই আশা মানুষের। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সমাধা হবে তার উদযোগ।
এর কোনটাই যে সহজ কাজ নয়, তা জানি। তবু সেই কঠিন কাজটিই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকেই তা করতে হবে।
এই কঠিন কাজে সে সফল হোক, এই কামনা, এই শুভেচ্ছা রইল।
সূত্র: ‘শেখ হাসিনা’ বই থেকে (তা. ০৭.০৬.২০০৯)।