ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে আমার ৫ সুপারিশ

কামরুল হাসান মামুন
কামরুল হাসান মামুন

আর কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পদার্পন করবে। এটি একটি মাইল ফলক।  এই সময়ে আমাদের পেছন ফিরে তাকানোর সময়।  পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখার দরকার আমাদের এলামনাইরা দেশ এবং দেশের বাহিরে কিরকম ইমপ্যাক্ট ফেলতে সক্ষম হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন ভালোর দিকে যাচ্ছে নাকি মন্দের দিকে যাচ্ছে ইত্যাদি।

এইটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্রমাগত নিরবিচ্ছিনভাবে খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। এরমধ্যে ১৯৪৭ সালের দিকে একটি বড় ধস আর ১৯৭১ এর দিকে আরেকটি বড় ধস। তাছাড়া স্বাধীনতার পর থেকেও আমাদের মানের অধঃপতন কমেনি বরং দিন যত গিয়েছে অধঃপতন ততই ত্বরান্বিত হয়েছে।

এখন শতবর্ষকে সামনে রেখে আমাদের কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।  একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো বা মন্দ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিক্ষকদের মান।  তাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন প্রক্রিয়া।  একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়াটি চলমান রাখে এবং নিয়ত চেষ্টা থাকে আরো উন্নত করা।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এটি মোটামোটি চলমান রেখেছে কিন্তু উন্নত করার পরিবর্তে এটিকে দুর্বল করেছে।

সারা বিশ্ব যখন এন্ট্রি লেভেলটা সহকারী অধ্যাপক করেছে আমরা সেই জন্মের সময় যা ছিল তাই রেখেছি অর্থাৎ প্রভাষক।  আর প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতির শর্তগুলোকে আমরা কেবল দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছি।  কল্পনা করা যায় যে কেবল ১২ টি প্রকাশনা (সেগুলো নিজ প্রতিষ্ঠানের কোন জার্নালে হলেও) দিয়ে শুধুমাত্র শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার জোরে একজন শিক্ষক অধ্যাপক হয়ে যেতে পারেন। আরে ১২টি প্রকাশনা দিয়ে পাশের দেশের কোন গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপকও কেউ হতে পারেনা।

সেখানে সহকারী অধ্যাপক হতে হলে পিএইচডি তো অবশ্যই লাগে তবে সেটাই যথেষ্ট না। সাথে লাগে একাধিক পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আর গবেষনা প্রকাশনার একটি মোটামোটি লম্বা লিস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে উন্নত করতে আমার সুপারিশ:

১. দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রভাষক পদটি থাকতে পারে কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে। শর্ত হলো কেবল পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পর চাকুরী স্থায়ী হবে এবং একই সাথে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। প্রভাষক পদটি হবে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের মত যারা কেবল ল্যাবে কাজ করবে, টিউটোরিয়াল নিবে এবং প্রয়োজনবোধে সর্বোচ্চ প্রথম বর্ষের ক্লাস নিতে পারবে।

২. কেউ যদি ১ থেকে ৩০০-র মধ্যে বিশ্ব রেঙ্কিং-এ আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে তাহলে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগে অগ্রাধিকার দিবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাশ্রয় হবে। বর্তমানে মাস্টার্সধারী শিক্ষকদের পিএইচডি করতে বেতনসহ ছুটি দিতে হয়। তাই পিএইচডি আছে এমনদের নিয়োগ দিলে বেতনসহ ছুটি দিয়ে একেতো আর্থিক ক্ষতি তার উপর বিশ্ববিদ্যালয় ওই কয়দিনের জন্য তার সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এছাড়া অনেকেই বেতনসহ ছুটি নিয়ে পিএইচডির পর আর ফিরে আসে না। তাছাড়া অনেকের পিএইচডি করতে না পারার রিস্ক থেকে যায়। এতসব ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা যদি নিয়ম করে দেই যে বিশ্ব রেঙ্কিং-এ ১ থেকে ৩০০-তে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি থাকলে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দিতে অগ্রাধিকার দিবে।

২. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যাদের পিএইচডি থাকবে তাদের এসএসসি, এইচএসসি এমনকি বিএস এবং এমএস রেজাল্ট দেখা বন্ধ করতে হবে যার পিএইচডি আছে তারতো ওসব আছেই। পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে স্কুল কলেজের রেজাল্ট জানতে চায়না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েরও রেজাল্ট জানতে চায় না। সেখানে পিএইচডি-র মান এবং গবেষণা প্রবন্ধ সংখ্যা আর তিনজন খ্যাতিমান অধ্যাপক/গবেষকের রেকমেন্ডেশন লেটারই মূল বিবেচ্য হতে পারে। এইসবই ইউনিভার্সাল নিয়ম।

৩. একই পদের যেমন সকল সহকারী অধ্যাপক বা সকল সহযোগী অধ্যাপক কিংবা সকল অধ্যাপকের বেতন এক হতে পারে না। গবেষক হিসাবে যে যত ভালো তাকে সেইরকম ইন্সেন্টিভ দিয়ে গবেষণাকে উৎসাহ দিতে হবে।

৪. প্রোমোশনের ক্ষেত্রে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার শর্তকে ডিভাইন শর্ত হিসাবে বিবেচনা বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ কেউ যদি গবেষণায় আলাদাভাবে ভালো হয় অর্থাৎ খুব ভালো মানের যথেষ্ট সংখ্যক গবেষণা প্রকাশনা থাকে তাকে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নাই এই অজুহাতে প্রমোশন থেকে বঞ্চিত করার রেযাওজ থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। সারা বিশ্বেই তাই করে এবং করে বলেই কেউ কেউ ৩০ বছর কিংবা তারও আগে অনেকেই অধ্যাপক হয়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ একাডেমিয়াতে বয়স কোন যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারেনা। এখানে কেবলই শিক্ষকতা ও গবেষণার মানই যোগ্যতার মাপকাঠি। কারো যদি পিএইচডি থাকে, খুব ভালো মানের আন্তর্জাতিক ভালো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরযুক্ত জার্নালে ধরুন ৫০টি আর্টিকেল আছে তাকে কোন যুক্তিতে অধ্যাপক বানাবেন না? এই ক্ষেত্রে তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আছে কিনা ইমমেটেরিয়াল।

৫. পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতাকে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। সারা পৃথিবীতে এমনকি ভারতেও এটা করা হয়। আমাদের এখানে কেন করা হয়না আমি জানি না।

৬. শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের ক্ষেত্রে বিভাগকে দায়িত্ব দিতে হবে। বিভাগের নেতৃত্বে একটি উঁচু মানের সার্চ কমিটি তৈরী করতে হবে যেখানে বিভাগের সি এন্ড ডির সকল সদস্য থাকবেন এবং একই সাথে দেশের বাহিরের শিক্ষক/গবেষককে এক্সটার্নাল নিরীক্ষক হিসাবে রাখতে হবে। তারা চূড়ান্ত নির্বাচন করবেন এবং ভিসি/প্রোভিসি চাইলে উনি চূড়ান্ত অনুমোদনের পূর্বে আরেকবার যাচাই করে দেখতে পারেন। মনে রাখতে হবে একজন ভুল শিক্ষক নিয়োগ অনেক বছর বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের অনেক ক্ষতি করতে পারে। তাই শিক্ষক নিয়োগে একাধিক ধাপ থাকা উচিত।

শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনে উপরোক্ত ৫ টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে আমি বিশ্বাস করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অবশ্যই খুব দ্রুত বাড়বে এবং আমরা আমাদের হারানো গৌরব আবার ফিরে পাব।

 

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ