বিশ্ববিদ্যালয়— ‘যেখানে আবদার, সেখানেই বাস্তবায়ন’
যেই জিনিস যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই জিনিসের জন্ম বা সৃষ্টিও তত বেশি painstaking এবং thorough হতে হয় বা হয়। হউক সেটা প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্য তৈরী। যদি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বুঝতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর ক্ষেত্রেও আমরা আরো অনেক বেশি সময় নিয়ে আলোচনা করে যত্ন নিয়ে তৈরি করতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টির সময় কিন্তু তাই হয়েছিল। পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেটা নিয়ে কত আলোচনা, সমালোচনা আর দেনদরবার। কত দুস্তরপথ পারি দিয়ে এই বাংলা একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পেছনে এবং সাথে যারা ছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। আর বুঝেছিলেন বলেই সেই রকম মানুষকে ভিসি বানিয়েছিলেন। তারা বুঝেছিলেন বলেই সেই সময়ের সেরা মানুষদের বিভাগীয় প্রধান ও শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই সৃষ্টির সময় থেকে শুরু করে ভারত বিভাগের আগে পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানেরই ছিল।
দেশ বিভাগের পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় যাদের হাতে গিয়েছে তাদের মান যতই দিন পেরিয়েছে ততই কমেছে। কমতে কমতে আজকের বাংলাদেশে এসে দাঁড়িয়েছি যখন না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন না রাষ্ট্রের প্রশাসন বুঝে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কত! তাই ক্রমান্বয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিরবিচ্ছিন্নভাবে খারাপ হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ৪৭ এর পর থেকেই। ৭১ এর পর এই ধারাবাহিকতা উল্টে গিয়ে ভালোর দিকে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তা হয়নি। আর ৯০ এর পর থেকে আরো ত্বরান্বিতভাবে খারাপের দিকে গিয়েছে এবং এখনো যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে শিক্ষক নিয়োগও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে তা নির্ভর করে শিক্ষকদের মানের উপর। সেই জন্যই সারা পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা সেটা বানিয়ে ফেলেছি জলবৎ তরলং সম। বিশ্বের কোন দেশের শিক্ষক নিয়োগ এত হেলাফেলাভাবে হয় না। কারণ আমরা শিক্ষকের গুরুত্ব বুঝিনা। তাহলে কি দাঁড়ালো? আমরা না বুঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব, না বুঝি তার শিক্ষকদের গুরুত্ব। সমস্যা হচ্ছে অনেকদিন ধরে আমরা এমন মানুষদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিচ্ছি যাদের অনেকের কোন কলেজের শিক্ষক হওয়ারও যোগ্যতা নাই। তাদের আচরণ দেখে সমাজে শিক্ষক সম্মন্ধে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরী হয়েছে। ওই তারাই এখন সংখ্যায় এমন আকার ধারণ করেছে যে তারা গণতন্ত্রের সংখ্যাধিক্যে এখন নেতৃত্বের চূড়ায় অবস্থান করছে। এরা যত না শিক্ষক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিবিদ। এরা যেই দল করে সেই দল ক্ষমতায় থাকলে একরকম কথা বলে আবার ক্ষমতার বাহিরে গেলে রাতারাতি সুর পাল্টে উল্টো কথা বলে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা এদের কি কারণে শ্রদ্ধা করবে আমাকে একটু বলবেন প্লিজ?
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গতকালকের লেখাটির কমেন্ট থ্রেডে আমার কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক বিমল সরকার একটি কমেন্ট করেছেন সেটি এখানে কাট-পেস্ট করলাম। পড়লে বুঝতে পারবেন আমাদের এখনকার সরকার বা প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কতটা বুঝে। ‘‘ঢাকা- ১৯২১, রাজশাহী ১৯৫৩, কৃষি (ময়মনসিংহ)- ১৯৬১, বুয়েট- ১৯৬৩, চট্টগ্রাম- ১৯৬৬, জাহাঙ্গীরনগর- ১৯৭০, উসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- ১৯৮১, খুলনা- ১৯৮৭, শাহজালাল- ১৯৯১ সাল। বাকি ৪০ বা ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল বা অবস্থানের কথা অনেক চেষ্টা করেও বলতে পারব বলে মনে হয় না। বছর বছর বা বছরে ২/৪টি করে স্থাপিত হওয়ায় এমন অবস্থা। আহারে, উচ্চশিক্ষা! বাগাড়ম্বর তবু কিছুটা সহ্য করা যায়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বাগাড়ম্বর? এ নিয়ে কী বলা যেতে পারে? ভাবনায় বৈকল্য দেখা দিলে তা কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে তা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় বেপরোয়াপনা দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়- ‘‘যেখানে আবদার, সেখানেই বাস্তবায়ন’’- আহা রে!’’
৯০এর গণঅভ্যূথানের পর থেকে আমরা মুদি দোকান খোলার মত করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে শুরু করি। এই ধারাবাহিকতাকে আরো খারাপ করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসি। যার কাজ আসলে শিক্ষা বোর্ডের মত অর্থাৎ কলেজকে অনার্স মাস্টার্স পড়ানোর অনুমতি দেওয়া, ছাত্র ভর্তি করা, প্রশ্ন করা, পরীক্ষা নেওয়া, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা আর সার্টিফিকেট বিতরণ করা। এর মাধ্যমে দেশে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন বিবিএ, এমবিএ, কম্পিউটার সাইন্সসহ সকল বিষয়ে মানহীন গ্রাজুয়েটের বাম্পার ফলন হয়। তাতে কি দেশের উন্নতি কিছু হলো? দেশের প্রাইভেট সেক্টরের উচ্চ পদের হাজার হাজার ভারতীয় ও শ্রীলংকানরা চাকুরী করে অথচ আমার দেশের লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েট বেকার। বেকার থেকে frustration-এ থেকে মাদকাসক্ত হওয়া থেকে শুরু করে নানারকম ধান্দাবাজি শিখতে বাধ্য হচ্ছে।
এমন কেন হচ্ছে? কারণ নীতিনির্ধারকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বুঝেন না। বুঝবে কিভাবে> যার হওয়ার কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রী তিনি হয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী আর যার হওয়ার কথা আইন প্রতিমন্ত্রী তিনি হয়েছে শিক্ষা উপমন্ত্রী। [ফেসবুক থেকে]
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।