ওয়াহিদা, ক্ষমা করো, বোন আমার!
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখতে বসেছি। বোন ওয়াহিদা, তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিও। আমরা নিজেদেরকে তোমাদের অভিভাবক বলে দাবী করি; সে দাবীতে কারণে-অকারণে শাসনও করি। কিন্তু ‘‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে’’- সেই নীতি মেনে সোহাগটুকু করতে পারিনি। অভিভাবক হিসেবে বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিতে পারিনি, আশ্রয় দিতে পারিনি, নিরাপত্তা দিতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও দুই কর্তৃপক্ষ পত্র চালাচালি করে কাটিয়ে দিয়েছে ২৫টি মাস। ডিসি থাকার সময় দেখেছি আমার ইউএনওরা দিন নাই, রাত নাই, ছুটির দিন নাই, কী অমানুষিক পরিশ্রম করে সকল প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে দেশ ও মানুষের সেবা করে। অথচ তাদের নিরাপত্তা, মাঠ পর্যায়ে সুশাসন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যথাযথ বাস্তবায়নের চেয়ে বড় হয়ে গেলো দাপ্তরিক ঠেলাঠেলি আর চিঠি চালাচালি।
মনে আছে, গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক থাকাকালীন ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মুখে যখন ইউএনওদের বাসভবনসহ তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছিলাম, তখন সুবিবেচক রাষ্ট্রনায়ক, মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থ মানবিক দৃষ্টিতেই বিষয়টি দেখেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, জনস্বার্থে ইউএনওগণ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, নদী-খাল দখল, অবৈধ বালু উত্তোলন প্রতিরোধসহ এমন অনেক কাজ করে থাকেন যাতে তারা প্রভাবশালী আইনভঙ্গকারী দুর্বৃত্তদের রোষানলে পড়েন। একেকটা বিষয় যখন যুক্তি সহকারে তুলে ধরছিলাম তখন সুবিবেচক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করছিলেন। আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি বললেন, ‘‘এটাতো খুবই দরকার। এতদিন করা হয়নি কেন?’’ এরপর তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয়কে দ্রুত ইউএনওদের বাসভবনসহ তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ প্রদান করেন।
কিন্তু আমরা পারলাম না। এ আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরেও উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। ধিক, শত ধিক জানাই নিজেদেরকে।
সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের আঘাতে আজ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদার মাথার খুলি ভেঙ্গে মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে।
ভিতরে ৬/৭ জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
সারাটা মগজে রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
শরীরের ডান পাশের অঙ্গগুলো প্যারালাউজড হয়ে গেছে।
ডাক্তারগণ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক নির্দেশনায় সিনিয়র জুনিয়র সহকর্মীগণ সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে চলেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই; তাঁর সিদ্ধান্তেই সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ওয়াহিদাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ সংকটকালে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য। রংপুর মেডিকেল, ঢাকার নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা করছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। পুলিশ দ্রতই ঘটনাস্থলে গিয়েছে এবং অপরাধীদের ধরার আন্তরিক চেষ্টা করছে। আশা করি তারা সফল হবেন। আগাম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম।
সবশেষে বলি, আর কোন ওয়াহিদা যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেজন্য অবিলম্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ইউএনওদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। তা না হলে দুর্বৃত্তরা আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে, দুষ্টের দৌরাত্ম আরও বেড়ে যাবে, সমাজ হয়ে পড়বে নিরাপত্তাহীন।
লেখক: যুগ্ম-সচিব ও সভাপতি, ১৭তম বিসিএস প্রশাসন ফোরাম