আনন্দময়ীর বিদায়
দিগন্তের সূর্য অস্ত গেলেও পরের দিন তা আবার উদয় হবে এই বিশ্বাস মানুষের থাকে। কিন্তু মানব জীবন কখনও অস্ত গেলে তা উদয়ের উপায় আর থাকে না। মহাবিশ্বের অনেক মহা মানব নিজের জীবনের অস্ত দিয়েছে অন্যের স্বাধীন জীবন উদয়ের জন্য। রাজশক্তির অপপ্রয়োগ যুগ যুগ ধরেই রাজা মহারাজারা করে এসেছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তারা বেছে নিয়েছে হাজারো দুষ্ট পথ।
সেই রাজ রোষানলে পড়ে পৃথিবীর কত মহামানবদের যে বিনা কারণে শাস্তি পেতে হয়েছে তার হিসাব নেই। এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেখকের মৃত্যু কার্যকরের পর প্রমাণ হয়েছে তাঁর ভাবধারাই ঠিক ছিল।এমন ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। রচনা হয়তো ফিরে পাওয়া গেছে কিন্তু লেখককে আর ফিরে পাওয়া যায়নি।
জগতখ্যাত লেখক দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি, ভলতেয়ার, মিলটন, তলস্তয়, ডারউইন, পাবলো নেরুদা, বরিস পাস্তর, সলঝিনিতের মত প্রমুখ মহাপুরুষ যুগে যুগে রাজরোষে কবলিত হয়ে নিপীড়ন নির্যাতন ভোগ করেছেন। বিনা অপরাধে জেলে বন্দি থেকেছেন যুগের পর যুগ।
রোমান নৃপতি টাইবেরিয়ানের কাজের সমালোচনা করায় ইতিহাসবিদ কসডাসকে কারাপ্রকোষ্ঠে অভুক্ত রেখে তিলে তিলে হত্যা করেন।
চতুর্থ লুই লেখক বোমারসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে কারাগরে নিক্ষেপ করেন। টমাস পেইন তাঁর বই ‘মানুষের অধিকার’ শীর্ষক গ্রন্থের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য রোজার বেকন দশ বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন।
‘‘সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে’’ গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের এই মতবাদের জন্য মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া তাকে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর হেমলক নামক বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে বলেছিলেন— ‘I to die, you to live, which is better only GOD knows’। বারবার সতর্ক করে দিয়েও মত না পাল্টানোর জন্য গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে প্রকাশ্যে পথে গির্জার যাজকরা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশ সবসময় ছিলো অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ব্রিটিশ শাসনামলে রাজশক্তি ব্রিটিশদের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রন্থ রচনার জন্য বহু ভারতীয় লেখকের রচনা বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। নামে, বেনামে, ছদ্মনামে অনেকেই ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে গ্রন্থ, গল্প, কবিতা লিখতো।
বালগঙ্গাধর তিলক, কবি মুকুন্দ দাস, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সখারাম, গনেশ দেউস্কর, গিরিশ চন্দ্র, সৈয়দ আবু মুহম্মদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রনাথ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সৌমেন ঠাকুর, সোমনাথ লাহিড়ী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলামসহ আরো যে কত লেখকের লেখা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তার হিসাব নেই। আবার বাজেয়াপ্ত না হলেও ইংরেজ সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন লেখকের সংখ্যাও কম নয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, সধবার একাদশী, নবীচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, প্রবাসের পথে, স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী, অরবিন্দের ভবানীমন্দির, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মেবার পতন ও রানা প্রতাপ, রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি প্রমুখ লেখকের লেখনির জন্য ব্রিটিশ সরকারের মিথ্যা মামলা অথবা হয়রানির শিকার হতে হয়।
তবে ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়তে হয়েছিল নজরুলকে। নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর সৈনিক।অন্যায়ের বিপক্ষে, সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের জন্য কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ শাসকের রোষানলে পড়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন।
শুধু তাই নয়, নজরুলের লেখার ওপর বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। নজরুলের যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। তাই নজরুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজরোষের মাত্রা কতটা ছিল তা এখান থেকেই অনুমান করা যায়। ১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন।
ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি রচনা করেছিলেন প্রলয়ংকরী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। কবিতার প্রত্যেকটি লাইনে ছিল ব্রিটিশ অপশাসনের ইঙ্গিত। ছিল প্রতিবাদ। মাটিরুপে দেবি দুর্গাকে তিনি অপশক্তি দমনের প্রতীক বিবেচিত করে অসুর রুপে ব্রিটিশ শাসনের বোধ প্রার্থনা করেছিলেন দেবী দুর্গার কাছে।
তাঁর এই কবিতা প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকারের ভীত পর্যন্ত কেপে যায়। নজরুলের লেখনি বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে ব্রিটিশ সরকার।
১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তির জন্য যুক্তির উক্তি দিয়ে এক জ্বালাময়ী অভিভাষণ প্রদান করেছিলেন নজরুল। সেই দীপ্তিময় উচ্চারণই পরিবর্তী সময়ে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্যের রুপালি পাতায় সোনালি অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নেয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার তাকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। কিন্তু ব্রিটিশরা নজরুলের বাঁশি কেড়ে নিলেও বাঁশির মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। কারণ বাঁশির সুর ছিল তার প্রাণে।
আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুল ছিলেন বিশেষ শ্রেণির কয়েদি। কিন্তু হুগলিতে স্থানান্তরের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদির মর্যাদার পরিবর্তে সাধারণ শ্রেণির কয়েদির অবস্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় নজরুল রচনা করেন জ্বালাময়ী ‘শিকল পরার গান’।
জেলখানার ভিতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে নজরুল এখানেও বিদ্রোহী হয়ে শুরু করছিলেন আন্দোলন। আন্দোলনের সূত্র ছিলো জেলখানায় পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি, ভাতের বদলে মাড় ভাত ও রাজবন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদ। এসব বন্ধের দাবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
একটানা ৩৯ দিন অনশন করে যান নজরুল। সেই সময় স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ ‘wrong address’ লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছা করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনের খবর শুনে জেলে গিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে জেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে দেখা করতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি হতাশ হতে হয়েছিল তাকে।
চুরুলিয়া থেকে নজরুলের মা জাহেদা খাতুনও নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হন। এসব সংবাদ খুব দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।
বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজলের সৃষ্টি তাঁরই হাত ধরে। ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গানের স্রষ্টাও নজরুল। হাজারো শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন তিনি।
নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সময় তাঁর সদ্য রচিত ‘বসন্ত’ নাটক নজরুলকে উৎসর্গ করেন। সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার বিস্মিত হয়েছিলেন যে ঠাকুর ঐ প্রিজনারকে বই ডেডিকেট করেছেন শুনে।
‘ব’ দিয়ে যতগুলো বিশেষণ বিচিত্র্য, বীর, ব্যতিক্রম, বিষ্ময়কর, বর্ণিল, বিদ্রোহী সবগুলোই নজরুলের সাথে যায়। সাহিত্যের যে কোন ব্যক্তির সাথে এসব প্রত্যয় যোগ বিয়োগ করে দেখলেও কখনো সবগুলো তাঁর সাথে মিলবে না। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে নজরুল বিচরণ করেননি।
জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত পার করার পর ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ আগস্ট কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। নজরুল তার শেষ ইচ্ছা স্বরুপ একটি গজলে বলেছিলেন,‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
এই মহাপুরুষের জানাজা শেষে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকামণ্ডিত কবির মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান।
কবির মহাপ্রয়ানে বাংলাদেশে তৎকালীন দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইন্সটিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট