ইমাম-হাবিবা রিলেশনশিপে আমি যা দেখেছি
আমি এই লেখাটি লিখেছিলাম আগেই, কিন্তু পোস্ট করিনি। কারণ ইমাম বেঁচে থাকতে হাবিবাকে অপমান করতে দেয়নি, তাই বন্ধু মারা যাওয়ার পরে সেটা করা উচিত মনে করিনি, কিন্তু এখন পোস্ট করতে হচ্ছে। আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ফেমিনিস্ট আমাদের ইমামকে দোষারোপ করছেন, চলুন ইমামের সত্য গল্পটা পড়া যাক।
উম্মে হাবিবা, বাড়ি রংপুর। ২০১৫-১৬ সালের দিকে উম্মে হাবিবা ইমামের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে, সেখান থেকে তাদের পরিচয় এবং প্রেম। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, ইমামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পেছনে একমাত্র অনুপ্রেরণা হাবিবার। ইমাম সারারাত পড়ত, অইপাশে হাবিবা জেগে থাকত। ইমাম ঢাবিতে চান্স পেয়ে পুরো ক্রেডিট হাবিবাকে দিয়েছিল।
২০১৯ সাল, আমরা ২২ জন কবি জসীম উদ্দীন হলের ২৩০ নম্বরটা রুমে থাকি। আমাদের গণরুমের মতো মিল আর কোনো গণরুম আমি দেখিনি। গণরুম চাঙ্গা রাখার জন্য ইমাম, সুমন, আর শাওন’ই যথেষ্ট ছিল। ২২ জনের ১৬ জনই প্রেম করে, আমি সবাইকে বলতাম ইমামের মতো খাঁটি প্রেমিক তোরা একটাও না।
মূল কথায় আসি, হাবিবা আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র। আমরা যখন ভার্সিটিতে পড়ছি হাবিবা এইচএসসি দিবে, মানবিক বিভাগ থেকে। তখন তাদের প্রেমের প্রায় ৩ বছর চলছে। ইমাম প্রতিদিন রাতে ফোনে ১-২ ঘন্টা করে হাবিবাকে পড়িয়েছে, যখন যে সমস্যায় পড়েছে ইমাম বুঝিয়ে দিয়েছে, হাবিবা এইচএসসিতে এ+ পেয়েছে। ইমাম একজন নটরডেমের স্টুডেন্ট, নটরডেমে ওর দাপট ছিল, শিক্ষকতায় বেশ পারদর্শী ।
হাবিবার এইচএসসির আগে রংপুরে, ইমাম ফোন করে কোনো এক ভাইকে ম্যানেজ করে হাবিবার প্রাইভেট পড়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল। অন্যান্য প্রাইভেট পড়ার টাকা ইমামই দিত। প্রতি ঈদে ইমাম হাবিবা এবং হাবিবার পরিবারের জন্য ঈদ শপিং করার জন্য টাকা দিত (ইমামের টিউশনের সব টাকা)। এইচএসসি শেষ, ইমামের একমাত্র স্বপ্ন হাবিবাকে ঢাবিতে চান্স পাওয়াবে, একসাথে ক্যাম্পাসের প্রেম হবে, গান হবে।
ইমামকে অনেক মেয়ে নক দিত, সব মেয়ের সাথে কথা বলত হাবিবা নিজে, কারণ ইমামের পাসওয়ার্ড ছিল হাবিবার কাছে, ইমাম ওদের পাত্তা দিত না। ইমাম বলত অমুক মেয়ে আমাকে নক দিয়েছে, তুমি কথা বল।
এডমিশন কোচিং করার জন্য হাবিবার বাবা হাবিবাকে ঢাকায় আসতে দিবে না, রংপুরে একটা কোচিংএ ভর্তি করিয়ে দিল, সেটাও ইমামের টাকায়, হাবিবার হোস্টেল খরচ ইমাম দিত। আমাদের ২২ জন থেকে আমি আর ইমাম এডমিশন কোচিং এর ক্লাস নেই ফার্স্ট ইয়ারেই, ইমাম প্যারাগনে খুব ভালো পজিশন করে নেয়, এডমিশন সিজনে ৩-৪ মাসে প্রথম সিজনেই ১ লাখ টাকার মত ইনকাম করে। যার বেশির ভাগ হাবিবার জন্য খরচ করে।
ইমাম প্রতিদিন ফোনে মেয়েকে একটা শিট পুরো বুঝিয়ে দিত, ইমাম ঢাকা থেকে দুইবার রংপুর গিয়েছিল হাবিবাকে পড়ানোর জন্য, ভালোবাসার মানুষটাকে ঢাবিতে চান্স পেতে হবে তো।দূর্ভাগ্যবশত হাবিবা ঢাবিতে চান্স পায়নি, ইমামের খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল। তারপর জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর আরো যে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা, ফরম তোলা, থাকা খাওয়া সব ইমাম করিয়েছে।
হাবিবা যখন ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবে হাবিবার বাবার থাকার ব্যাবস্থা ইমামই করে দিয়েছে। আর হ্যাঁ, হাবিবাকে কিন্তু ইমাম আমাদের হলে রেখেও হল ক্যান্টিনের খাবার খাওয়ায়নি, ঢাকার বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়াইছে, কিন্তু ইমামের টাকা তখন ফুরিয়ে গেছে, কারণ এডমিশন কোচিং ক্লাস শেষ, তখন টাকা আমাদের কাছ থেকেই নিয়ে সুফিয়া কামাল হলে বিরিয়ান, কাচ্চির প্যাকেট দিয়ে আসত।
ভর্তি পরীক্ষার পরেই হাবিবার মন ভালো করার জন্য উত্তরার দিয়া বাড়িতে ঘুরতে নিয়ে গেছিল, আসার সময় হাবিবার কষ্ট হবে বলে আমি আর শাওন রাজি না থাকা সত্ত্বেও ইমাম হাবিবার জন্য এসি বাসে করে ফিরেছিল, নিচের ছবিটা দিয়া বাড়িতে উঠানো, এই ছবিটি আমি ট্রিটের বিনিময়ে ওরে দিছিলাম।
হাবিবা চান্স পেলে আমাদের ২২ জনকে ইমাম কাচ্চি খাওয়াবে বলেছিল। এ+ পাওয়ায় ও খাওয়াইছিল।
হাবিবা শেষ মেশ রবিন্দ্র ভারতী আর ইডেন কলেজে চান্স পেল। হাবিবার বাবা হাবিবাকে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইমাম হাবিবাকে ইডেন কলেজে ভর্তি করবে, সেকেন্ড টাইম জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি করাবে, ইমাম আবার নিজ হাতে হাবিবাকে প্রস্তুত করবে।
ইমাম নিজের টাকায় হাবিবাকে ইডেনে ভর্তি করল, আপুর মাধ্যমে হলে উঠালো, বই কিনে দিল, আবার হোস্টেলে দিল, থাকা খাওয়ায় খরচ দিচ্ছিল।
ডিসেম্বার ২০১৯, সবার যখন সেমিস্টার ফাইনাল শেষ ২৩০ নম্বর রুম খালি, আমি আর ইমাম শুধু ছিলাম।আমি টিউশনি করতাম আমার ফ্যামিলির জন্য, ইমাম টিউশনিতে করত হাবিবার নাকের অপারেশন করানোর জন্য। এক প্যাকেট ভাত দুজনে ভাগ করে খেতাম । ইমাম ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে টিউশনির টাকায় হাবিবার নাকের অপারেশন করিয়েছে।
২০২০, হাবিবা ইডেনে পড়ছে, ঝামেলা শুরু এই জানুয়ারি থেকেই। হাবিবা কোনো কারণ ছাড়াই ইমামকে ইগ্নোর করা শুরু করে, কারণ হিসেবে বলে, হাবিবার আব্বা নিষেধ করেছে যোগাযোগ করার জন্য।
শাহেদের বান্ধবী ইডেনে পড়ে, তাকে দিয়ে হাবিবাকে অনেক বুঝিয়েছে, কাজ হয়নি, ইগ্নোর বাড়তেই থাকে।
ফেব্রুয়ারী ২০২০। ভ্যালেনটাইন ডে আর পহেলা ফাল্গুন। ইমাম হাবিবার জন্য শাড়ি কিনেছে, বেশ কয়েকবার দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু হাবিবা শাড়ি নেয়নি, পরে আমি ফোন করে হাবিবাকে অনেক বুঝিয়েছি, রিকুয়েষ্ট করেছি, শেষমেশ শাড়ি নিয়েছিল।
ইমাম ভেঙে পড়তে শুরু করে, আমরা অনেক বুঝালাম, মার্চ মাসে আমরা লকডাউনে বাড়িতে চলে আসছি। বাড়িতে ইমামের ডিপ্রেশন বাড়তে থাকে, অনেক বুঝাই কাজ হচ্ছিল না। আমি নিজে ব্যার্থ হয়ে পরামর্শ দিয়েছিলাম, ইমাম তুই একজন মুফতি সাহেবের সাথে কথা বল।
এদিকে হাবিবা ইমামের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। ইমাম দিনের পর দিন, মেসেজ দিচ্ছিল, হাবিবা ইমামের রিপ্লাই দিচ্ছিল না।
জুলাই থেকে আত্মহত্যার পোস্ট দেওয়া শুরু করলে ইমামের সাথে সবসময়েই কেউ না কেউ পাহাড়ায় থাকত। ইমামের এই অবসর দেখে ইমামের আব্বা-আম্মা হাবিবার বাবার সাথে যোগাযোগ করে, হাবিবার বাবা স্রেফ বলে আমরা কিছু জানিনা।
মাসকয়েক ধরে ইমাম হাবিবাকে সন্দেহ করা শুরু করে, ইমাম আমাকে বলেছিল হাবিবার আইডি হ্যাক করে দিতাম। কারণ হাবিবাকে একটা ছেলে পছন্দ করত, হাবিবা সেই ছেলের মেসেজের রিপ্লাই দিত।
হাবিবার মা ইমামকে জামাই ডাকত, হাবিবার বাবা হাবিবাকে জামা কাপড় কিছুই কিনে দিত না। এমন বাবা আবার হয় নাকি? হ্যাঁ, মেয়ের বাবা হাবিবার জন্য খরচ না করে শুধু টাকা জমাত, বাড়ি বানাত, মেয়ের জন্য ইমাম তো আছেই, তারা ৩-৪ বছর ইমামের সবকিছু গ্রহণ করেছে। ২০২০ সাল থেকে তাদের আর ইমামের প্রয়োজন হচ্ছিল না।
মেয়ের বাবা ইমামকে বলেছিল এস্টাবলিশড হতে পারলে ইমামের কাছেই মেয়েকে বিয়ে দিবে। কিন্তু মেয়ের বাবা ঈদের আগে থেকেই মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করে ফেলেছিল।
৩০ জুলাই ২০২০, ইমাম আমার কাছ থেকে একটা হজ্বের ভিডিও নিয়ে বলেছিল, হাবিবা আর আম্মাকে নিয়ে সেও একদিন হজ্জ্বে যাবে।
ঝুলে যাওয়ার আগেরদিন সাথে চারজন বন্ধু ছিল, সারারাত আড্ডা দিয়েছে, সকালে বন্ধুরা চলে যায়, সকাল ৯টা ৫৬ তে এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে বলেছিল আয় কার্ড খেলি, বন্ধু আসেনি, এদিকে ইমাম ঝুলে গেছে।
ইমামের মারা যাওয়ার পর আমরা ইমামের ছোট ভাই ইমামের আইডিতে ঢুকেছিলাম, গিয়ে দেখে ইমাম হাজার হাজার মেসেজ দিয়েছে হাবিবাকে, কিন্তু হাবিবা ইমামকে ইগ্নোর করে রেখেছিল। সেই মেসেজে দেখেছি, ইমাম বলেছিল, হাবিবা তুমি পাশে থাকলে আমি জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্যকে অর্জনে করে দেখাব। হাবিবা পাশে নাই, জীবনটাই দিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা! এবার আসি যারা এখনো মেয়ের কোনো দোষ দেখছেন না তাদের কাছে...
ছেলে হিসেবে একটা মেয়ে, সরি মেয়ে না, ভালোবাসার জন্য এতকিছু করতে পারবেন? একটা মেয়ে হয়ে বফ এর কাছে এতকিছু এক্সপেক্ট করেন? আপনার আদরের যমজ ভাই একটা মেয়ের জন্য জীবনে এতকিছু করল, সেই মেয়ের জন্যই আদরের ভাই মারা গেল, এখন ভাই হিসেবে মেয়ের জন্য মামলা করার কথা বলা কি ভাই হিসেবে ইমাম হাসানের অন্যায় হয়েছে? পরিবার কি বিচারের কথা বলতে পারে না? মেয়ের বাবা এতকিছু গ্রহণ করার পরেও কেন পল্টি নিল?
আশা করি ইমামকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার আগে নিজেকে একজন প্রেমিক,ইমামের ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখবেন।
আমি ইমামের কাজটাকে কোনোভাবেই সাপোর্ট করি না,ইমাম ভুল করেছে, অনেক বড় ভুল করেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইমামের রুমমেট