পেশা নির্বাচনে অর্থের চেয়ে মেধা বিকাশে গুরুত্ব দিন
শিক্ষক জাতি গঠনের অন্যতম কারিগর। শিক্ষকের আদর্শ, চেতনা ও মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে। তাই শিক্ষক হিসেবে আজ আমি এই মহামারিতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য জীবনের ছোট-ছোট কিছু বিষয় এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।
ছোট্ট বন্ধুরা, আপনারা জানেন, আমরা এখন নিজেদের নিরাপদে রাখতে ঘরে থাকছি। আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে বাসায় থাকার এ সময় যেনো কোনোভাবেই অবহেলায় নষ্ট না করি। সময়কে যথাসম্ভব ভালো কাজে ব্যয় করতে হবে। দিনভর টিভি, ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যমের স্পর্শ অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। সারাদিনে দুই থেকে তিনবার, শুধু নির্দিষ্ট সময়ে এগুলো দেখুন বা ব্যবহার করুন।
আমাদের এখন করোনার সাথে যুদ্ধ করে তাকে হারানোর জন্য নিজেদের শরীর ও মনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে ফলমূল, শাক সবজি বেশি খাবো। চর্বিদার ও গুরুপাক খাবার যত কম খান ততোই ভাল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ বা নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করবো।
এরপর সবাই একসাথে হালকা ব্যায়াম, যোগ ব্যায়াম করবো। ইউটিউব দেখে আমরা এসব ব্যায়াম খুব সহজে শিখে নিতে পারি। এতে আমাদের মানসিক ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এরপর সকালের নাস্তা খেয়ে কিছুসময় পড়ালেখা করবো। নিজের কাজগুলো নিজেরা করবো যেমন- নিজের বিছানা, জামা কাপড়, বই খাতা গুছিয়ে রাখা। ঘরের কাজে সাধ্যমতো সহযোগিতা করুন।
এর মধ্যে আমরা শিখে গেছি স্বাস্থ্য সচেতন বা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নভাবে থাকা কঠিন কাজ নয়। ভালোভাবে সাবান দিয়ে প্রতিদিন গোসল করতে হবে। রোদ পোহানোর অভ্যাস করা খুব ভালো। রোদে ভিটামিন-ডি আছে। তাছাড়া ভিটামিন-ডি যুক্ত খাবার যেমন- তৈলাক্ত মাছ খেতে হবে। এছাড়া, অন্যান্য সুষম খাদ্য খেয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে তুলতে পারি যাতে করোনার সাথে যুদ্ধ করে তাকে হারাতে পারি।
বাবা-মা পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প করে, গল্পের বই পড়ে, ছবি এঁকে, গান, নাচ করে, বাবা-মার সাথে সিনেমা দেখে সময়গুলো সুন্দরভাবে কাটাতে পারি। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের বাংলা অর্থ সবাই একসাথে বসে পড়তে বা শুনতে পারি।
যেহেতু এখন বাসায় আছেন, ব্যস্ততা কম। তাই নিজের মত করে জীবনের লক্ষ্য স্থির করুন। বড় কিছু করার জন্যই আপনি পৃথিবীতে এসেছেন- এ বিশ্বাসকে লালন করুন। পেশা নির্বাচনে অর্থ উপার্জন ও সুযোগ সুবিধা নয়, বরং নিজের মেধার বিকাশ ও মানবকল্যাণে কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন তা নিয়ে ভাবুন। করোনার এই মহামারিতে সময় সুযোগ করে স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নিন। মেধা ও শ্রম দিয়ে মানুষের কল্যাণের কথা ভাবুন এবং সুযোগ আসলে কাজ করুন, তাহলে জীবনে বড় কিছু করতে পারবেন।
অনেক মানুষ কাজে যেতে পারছেন না। তাদের খাবার কেনার টাকা যোগাড় করতে পারছে না। তাদের সাহায্য করার পরিকল্পনা করতে পারি বড়দের সাথে। মনে রাখবেন, অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার এখনই সবচেয়ে বড় সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। আপনার ছোট সঞ্চয় এখন আর্তমানবতার জন্য দান করতে পারেন।
বোখারী শরীফের এক হাদিসে এসেছে, সাদাকা বা দান করা প্রত্যেক বিশ্বাসীর কর্তব্য। যার আর্থিক সামর্থ্য নেই তার জন্য যে কোন সৎ কাজ করা বা খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখাও দান বা সাদাকা। আবার রোগাক্রান্ত মানুষের সুস্থতার জন্য দোয়া করাও দান।
বিকেলেও একটু শরীর চর্চা করে নিতে পারি। রাতে খাবার ৮টার মধ্যে খেয়ে ফেলতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার অভ্যাস করে ফেলবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে বড়দের সালাম দিবেন। অবশ্যই রাত ১০টার আগে ঘুমিয়ে যেতে হবে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বলুন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ বা থ্যাংকস গড বা হরি ওম বা প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ, একটি সুন্দর দিনের জন্য।
মা-বাবা, পরিবারের বড়দের উদ্দেশ্যে বলবো- ঘরে বসে নিজেদের মানসিক শক্তি বাড়ান, শারীরিক সক্ষমতা বাড়ান, পুষ্টিকর খাবার খান। পুষ্টিকর খাবারের তালিকা করুন। পারিবারিক বন্ধন বাড়ান, একসাথে সময় কাটান। আপনার সন্তানদের নিয়ে স্ব স্ব ধর্ম চর্চা করুন এবং তাকে শুদ্ধাচার শিক্ষা দিন। প্রতিদিন কিভাবে সময় কাটাবেন তার একটি চার্ট তৈরি করুন। সুযোগ থাকলে এ পরিস্থিতিতে যারা অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছেন তাদের আর্থিক সাহায্য করুন। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, হিংসা, পরচর্চা পরিহার করে মানুষকে ভালোবেসে তাদের জন্য কি করা যায় সেটাই চেষ্টা করুন।
মনে রাখবেন, আমরা একটা বিরাট সুযোগ পেয়েছি পরিবার সন্তানদের সাথে গৃহে বাস করার। আমরা জানি, বেঁচে থাকার জন্য আসলে তেমন বেশি কিছু দরকার হয়না। স্বাস্থ্য সচেতন বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে থাকা কঠিন কাজ নয়।
গৃহববন্দি ভেবে অস্থির হবেন না। আপনি আপনার আর আপনার পরিবারের সাথে গৃহবাস করছেন। আনন্দে থাকুন, আপনার পরিবার শিশুদের আনন্দে রাখুন। নিজেকে প্রকৃতির মতো করে গড়ে তুলুন। আসুন নিজের জীবনকে সুন্দর করে তুলি। সাথে সাথে আমাদের পৃথিবীও আমরা সুন্দর করে তুলি নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
আবারো বলছি ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষার আলোকে পারিবারিক মূল্যাবোধ গড়ে তুলুন এবং পারিবারিকভাবে সেগুলোর চর্চা করুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ইন্টারনেট ব্যবহার এবং টেলিভিশন দেখা কমিয়ে দিন। নিজের এবং সন্তানদের সময়কে ভালো কাজে ব্যবহার করুন। গুজবে কান দিবেন না। নিজে আতঙ্কিত না হয়ে বরং অন্যদের মাঝে সাহস সঞ্চয় করুন।
সামনে রমজান। এ সময়ে আমরা নিজেদেরকে গুছিয়ে নেয়ার বড় ধরনের সুযোগ পাবো। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাওয়া, প্রার্থনাসহ সবকিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও অধ্যক্ষ, চেরী ব্লোসমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ