‘‘ইমামকে আপনার মত বুঝদার হতে হবে কেন?’’
তোমাকে পাবো পাবো বলেই আত্মহত্যার তারিখটা পিছিয়ে দেই। এই কথা লিখে আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমাম হোসেন।
তিনি সুইসাইডের আগে তাঁর ফেসবুকে আরো লিখেছেন সুনীলের এই কথা, বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি একশো আটটি নীলপদ্ম। তবুও কেউ কথা রাখেনি।
ইমামের এই স্ট্যাটাস স্পষ্টতই প্রেমের প্রতি তাঁর প্রবল আকুতির বহিঃপ্রকাশ। আমি প্রথমেই ইমামের প্রচন্ড এই ভালোবাসার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা জানাই।
ইমামের এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ তাঁর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করছেন এবং পরাজিত এক তরুণ বলে তাকে নিয়ে হাস্যরস করছেন।
ধরে নিলাম ইমাম বোকা। পরাজিত তরুণ। তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল ইমামকে আপনার মত বুঝদার হতে হবে কেন? ইমামের বয়স আর আপনার বয়স তো এক নয়। তাঁর জীবন দর্শন আর আপনার জীবন দর্শন তো এক নয়।
কেউ আত্মহত্যা করলেই দেখছি বিশাল একদল জ্ঞানী ছুটে এসে মৃত সেই মানুষটাকে জ্ঞান দেয়!
তার কি কি ভুল ছিল কি কি সঠিক ছিল এসব বলে। কি আজব ব্যাপার!
ইমাম কেন আত্মহত্যা করবে সেই কৈফিয়ত কি সে আপনাকে দিবে?
সবকিছু নিয়ে বাজি চলে না। প্রেম নিয়ে সবাই জুয়াচুরি করতে পারেনা। পারা ঠিকও না। ইমামও তাই পারেনি।
কেউ কেউ তাঁকে মৃত্যুর আগে কাউন্সেলিং এর কথা বলছেন! কি দারুণ কথাবার্তা!
কাউন্সেলিং কি যে সুইসাইড করে তার করা দরকার নাকি যার কারণে সুইসাইড করে তার দরকার?
যাদের জন্য ইমামরা সুইসাইডকরে কাউন্সেলিং তো তাদের দরকার। যাতে তারা আর কোন আত্মহত্যার ক্ষেত্র তৈরি না করে।
অন্যের চিন্তা বা সিদ্ধান্তকে অসম্মানিত না করে নিজেকে প্রশ্ন করুন মানুষ কেন সুইসাইড করে?
সুইসাইড বা আত্মহত্যা নিয়ে সারা দুনিয়ায় কাজ আছে। সুইসাইডের পক্ষে বিপক্ষে ডিবেট আছে। একাডেমিক ভাবেও এই তর্ক চলছে শত সহস্র বছর ধরে। সেসব নিয়ে একটু পড়ুন। মাথা খুলে যাবে।
এ্যাবসার্ডটিজম, ডেওন্টলজি, সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট কিংবা লিবারেলিজমে যেমনি আলববেয়ার কাম্যু, ইমানুয়েল কান্ট, জাঁ জ্যাক রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিলরা সুইসাইডের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
তেমনি আইডিয়ালিজম, লিবার্টারিয়ানিজম, স্টিসিজম, কনফুসিয়ানিজমে হেরোডোটাস, থমাস জাজসরা এর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
আবার আলবেয়ার কাম্যুরা যে সরাসরি সুইসাইডের বিপক্ষেই ছিলেন তাও নয়। যেমন ধরুন, তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য মিথের সিসিফাসে লিখেন, আমাদের একটি গুরুতর দার্শনিক সমস্যা আছে। আর সেটি হল আত্মহত্যা। তারমানে তিনি সুইসাইড নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
তবে হেরোডোটাস এবং বিখ্যাত সাইক্রেটিস্ট ও দার্শনিক থমাস জাজস আত্মহত্যার পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন।
হেরোডোটাস বলেছেন, জীবন যখন বার্ডেন হয়ে যায়, তখন মৃত্যু মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে থমাস জাজসও মনে করেন, আত্মহত্যা হ'ল মানুষের বুনিয়াদি অধিকার। স্বাধীনতা যদি সেলফ ওনারশিপ হয় এবং সে ওনারশিপ যদি একজন মানুষের জীবন এবং শরীরের হয়। তাহলে সেই জীবন শেষ করার অধিকার ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। আর আপনি যদি অন্যের কথায় বাধ্য হয়ে কিংবা প্রভাবিত হয়ে বাঁচার স্বপ্ন দ্যাখেন তারমানে সেই শরীর ও জীবনের মালিক আসলে আপনি নন।
একটা ঘটনা বলে শেষ করতে চাই।
১৯৩৩ সালে হাঙ্গেরিয়ান কবি ল্যাজলো জাভিয়ের মিউজিক কম্পোজার রেজসো সেরেস এবং গায়ক পল কেলমার মিলে সৃষ্টি করেছিলেন এক বিষণ্ণ রবিবারের। সৃষ্টি করেছিলেন একটি গান যা সারা পৃথিবী জুড়ে 'সুইসাইড সং' বা 'আত্মহননের সংগীত' নামে বিখ্যাত। যে গান চীন, জাপান, রাশিয়াসহ হলিউড ইংরেজি করেছিল ‘গ্লুমি সানডে’ নামে। যে গান ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত বিবিসি নিষিদ্ধ করে রেখেছিল কয়েক যুগ। যে গান লেখার ৩৫ বছর পরে সেরেস নিজেই উঁচু ভবনের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেছিল। যে গান শুনে হাঙ্গেরিতে কয়েকশ মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু কেন?
ইমাম কেন আত্মহত্যা করল এই প্রশ্ন করার আগে এক গান শুনে কেন শত শত মানুষ আত্মহত্যা করল সেই প্রশ্ন করুন।
এ ট্রু লাভ ইজ এ্য সুইসাইডাল প্রসিডিওর।
লেখা: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত