আমার কি অনেক আগেই আত্মহত্যা করা উচিত ছিল?
জীবনের এই পর্যায়ে এসেও যে পরিমাণ অবহেলা এবং অবজ্ঞা নিয়ে আমি বেঁচে আছি; সে কেবল আমি জানি। তো, আমার কি উচিত আত্মহত্যা করা? মানুষজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, কতজন কতো কি বলে বেড়াচ্ছে; এইসব দেখে দেখেই তো আমি বড় হয়েছি। অনেক সময় মনে হয়েছে- আর নাহ! এরপর আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।
চারপাশের মানুষজন পারলে বলে দেয়- তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। নাহ, এরপরও থেমে যাইনি। নিজের মতো করে উঠে দাঁড়িয়েছি।
ছোট বেলা থেকে বড় বেলা; জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে দেশ-বিদেশের নানান জায়গায় পড়াশুনা করতে হয়েছে। অর্জন করতে হয়েছে নানান অভিজ্ঞতার। নাহ, এরপরও সেই হাসাহসি থামেনি। সমাজের চোখে প্রতিষ্ঠিত এই আমাকেও নিজের ব্যক্তি জীবনে নিয়ম করে শুনতে হয়- তুমি কিন্তু অন্যদের মতো নও। তাই উঁচু গলায় কথা বলা তোমার মানায় না। এরপরও আমি হার মানিনি।
ঠিক এই মুহূর্তের কথা বলি। গতকাল সকাল থেকেই ঠাণ্ডা লাগছিলো। সর্দি ভাব। আজ সকাল থেকে জ্বরও চলে এসেছে। আমার শরীরটা এমনিতেই বেশ কিছু দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। বলা যায় এক রকম যুদ্ধ করছি। কেবল আমি জানি শরীর এবং মনের কী ভয়ানক যুদ্ধটাই না আমাকে করে বেড়াতে হচ্ছে!
শরীরের এই অবস্থায় আমার আশপাশে কিন্তু কেউ নেই। নিজের সমুদয় কাজগুলো নিজেকেই করতে হচ্ছে। এতে অবশ্য আমার কখনোই খারাপ লাগেনি। আমি উল্টো নিজের দুর্বল চেহারাটা কখনো কাউকে দেখাতে চাইনি। বাইরে বের হলে মানুষজন আমাকে দেখে বলে বেড়ায়- বাহ, আপনাকে কি চমৎকার লাগছে! অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না এই চমৎকার দেখানোর জন্য কি যুদ্ধটাই না আমকে প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে!
কিন্তু মানসিক প্রশান্তিরও তো একটা ব্যাপার আছে। আপনার খুব কাছের কিংবা প্রিয়জনদের আপনি কাছে পেতে চাইবেন যখন শরীর খুব খারাপ করে। অন্তত মানসিক প্রশান্তির জন্য। অথচ দিনশেষে আমি আবিষ্কার করি- কোথাও কেউ নেই!
নাহ, এতেও আমি থেমে যাচ্ছি না। যাপিত জীবনে আমি শিখে গেছি- নিজের দুর্বলতা কাউকে বলতে নেই। দেখাতে নেই। এতে মানুষের করুণা পাওয়া যায় কিংবা হাসাহাসি। এর বেশি কিছু নয়। মানুষ চায় আপনি খারাপ থাকুন। মানুষ শুনতে চায়- আপনি খারাপ আছেন।
আপনি ভালো আছেন, ভালো কিছু করছেন; এমনকি যার বা যাদের জন্য ভালো কিছু করছেন; এদের কারোই কিছু যায় আসে না আপনার ভালো থাকা নিয়ে। আপনি ভালো আছেন এটা মানুষ শুনতে চায় না। আপনি খারাপ থাকলে সেটা নিয়ে তারা কথা বলবে; হা-হুতাশ করবে এবং দিন শেষে এক ধরনের আনন্দ পাবে এই ভেবে- যাক বাবা কেউ কেউ তো আমার চাইতেও খারাপ আছে!
মানুষের জীবনে আত্মহত্যার চিন্তা যে আসবে না; এমন না! আমার ধারণা জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে অনেকেই হয়ত ভেবেছে- বেঁচে থেকে আর লাভ কি! আমার মাঝেও যে কখনো আসেনি, এমন না।
এরপর আমি ভেবেছি- আমি মরে গেলে আমার জীবনটাই গেল। কারো কিছু এতে যায় আসবে না। মানুষজন কি ভাববে জানেন? আপনার শেষযাত্রায় আপনাকে শুইয়ে দিয়ে এসে বিজয়ের ভাবনা ভাববে এই ভেবে- আমি তো বেঁচে আছি। হ্যাঁ, এমনটাই হয়।
কখনো কি কবরে রেখে আসা মৃতদেহের আশপাশের মানুষজনদের ভালো করে খেয়াল করেছেন? ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন- শোকের পাশাপাশি তাদের মাঝে এক ধরনের বিজয়ের প্রশান্তিও কাজ করে। হ্যাঁ, বেঁচে থাকার প্রশান্তি!
আমরা যারা ভালো থাকি, আমরা ভাবি- আমি তো ভালো আছি! আমরা যারা দিনশেষে বেঁচে থাকি, আমরা ভাবি- আমি তো বেঁচে আছি। অন্য আর কার কি হলো, না হলো এতে আমাদের কিছু'ই যায় আসে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটা আজ আত্মহত্যা করেছে; তাকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে- তোমার দুঃখ কি আমার চাইতেও বিশাল ছিল?
একটা মেয়ের সাথে তোমার প্রেমে মিলছে না; এই জন্য তুমি আত্মহত্যা করে ফেললে। তোমার কি জানা ছিল- পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে- যাদের জন্য ভালোবাসার চিন্তা করাটাও অপরাধ? যাদের সাথে প্রয়োজনে-অপ্রয়জনে কথা বলা যায়, মেলামেশা করা যায় কিন্তু ভালোবাসা? মোটেই নয়!
তারাও বেঁচে থাকে। কারণ পরাজিত মানুষকে এই পৃথিবী মনে রাখে না। পরাজিত মানুষের কোন স্থন পৃথিবী নামক এই গ্রহে নেই।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়