পুলিশের একটু নিরাপত্তা পেলেই বেঁচে যেত ছেলেটা— তসলিমার আবেগি স্ট্যাটাস
পাঁচ বছর আগে আগস্ট মাসের সাত তারিখে, এই দিনে, এরকম দুপুরবেলায় বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলের ঢাকার ফ্ল্যাটে চার পাঁচ জন মুসলিম সন্ত্রাসী ঢুকে ওকে কুপিয়ে মেরেছিল। নিজের রক্তের ওপর নিথর পড়ে ছিল আমাদের নিলয় ।
২০১৫ সালটা ছিল ভয়াবহ। এক এক করে খুন করা হচ্ছিল নাস্তিক ব্লগারদের। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়। তারপর নিলয় নীল। পুলিশকে নিলয় জানিয়েছিলেন তিনি নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছেন, কারণ তিনি লক্ষ করেছেন কিছু লোক তাঁকে অনুসরণ করছে।এরপরও পুলিশ নিলয়ের জন্য নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেনি।
নিলয় দর্শনে মাস্টারস করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তুখোড় মেধাবী এবং বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ ধর্ম বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ব্লগ লিখতেন। দুনিয়ার সব ধর্মেরই সমালোচক ছিলেন, কিন্তু একটি ধর্মের সন্ত্রাসীরাই তাঁকে আর বাঁচতে দেয়নি। খুনীদের কি শাস্তি হয়েছিল? না, আজ পর্যন্ত নাস্তিক ব্লগারদের একটি খুনীকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি। সরকারের অশেষ কৃপায় তারা নিশ্চয়ই এখন নিরাপদে নিশ্চিন্তে আর বহাল তবিয়তে আছে।
এই আমার সোনার বাংলাদেশ। সোনার ছেলেরা মৃত। দু’একজন ছাড়া কোনও বুদ্ধিজীবীই প্রতিবাদ করেননি ওই সব বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। জনগণ ব্লগারদের দোষ দিয়েছিল, ইসলামের সমালোচনা করা ব্লগারদের নাকি উচিত হয়নি, দোষ খুনীর নয়, দোষ নাকি সমালোচনার। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করলে নৃশংস ভাবে খুন হয়ে যেতে হবে,যাওয়া উচিত... অধিকাংশ মানুষের এমনই বিশ্বাস।
মনে আছে ২০১৫ সাল জুড়ে কী ভীষণ উদবিগ্ন আমি, দিন রাত ঘুম নেই। অভিজিৎ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল, ওয়াশিকুর ছিল আমার ফেসবুকের বন্ধু, অনন্ত ছিল সমমনা যুক্তিবাদি। তখন প্রতিদিন ব্লগ লিখছি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে, আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে চিৎকার করে। আমার ফ্রি থট ব্লগ থেকে ইউরোপ আমেরিকার মুক্তচিন্তক-নাস্তিক মানুষেরা জানতে পারছেন কী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে। তাঁরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরাও উদবিগ্ন। আবেদন করছি বিভিন্ন সংগঠনের কাছে যেন তারা বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার করে।
সে বছর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাখারভ পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে দু’দুবার আমি আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার জন্য, শুধু তাই নয়, বেলজিয়ামের সেনেট , ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরের মতো আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আমাকে সেমিনারে, লেকচারে; প্রতিটি প্লাটফর্ম আমি ব্যবহার করেছি বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন করে, যেন ব্লগারদের বাংলাদেশ থেকে বের করে ইউরোপ- আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট এবং সদস্যদের সংগে দিনভর বাইল্যাটারাল মিটিংও করেছি ও নিয়ে।
যে সংস্থাগুলো ব্লগারদের ইউরোপে আশ্রয় দিয়েছে, নিরাপদ জীবন দিয়েছে, সেই সংস্থাগুলোর ফাণ্ড ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে যায়। কী স্বস্তি যে পেয়েছি নাস্তিক ব্লগাররা যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গেছেন, যে দূরত্বে গেলে ইসলামি সন্ত্রাসীদের হাত তাঁদের নাগাল পায় না। আমি সামান্য মানুষ। ক্ষমতাবান নই, প্রভাবশালী নই। আমার ওই চেষ্টার ফলে কতটুকু কী হয়েছে হিসেব করে দেখিনি। তবে আমার ওই যে ঝাঁপিয়ে পড়া, যে মানুষগুলোর পাশে দেশের কেউ দাঁড়াচ্ছে না, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবনকে বাঁচানোর জন্য যে মরিয়া হয়ে ওঠা... এরকম দিন এলে মনে পড়ে সেসব।
মাঝে মাঝে লক্ষ করি বিদেশের নিরাপদ জীবনে বসে কিছু ব্লগার আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। তা করুন। বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই যখন করি, তাঁদের বিষোদগার করার স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করি। তাঁরা নিরাপদে আছেন, এ ভেবেই আমি সুখী। শুধু আফসোস, নিলয় নীলের জন্য কিছুই করতে পারিনি। পুলিশ যদি নিরাপত্তা দিত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেতেন নিলয়। প্রতিভাবান মুক্তচিন্তককে অকালে আমাদের হারাতে হতো না। কিন্তু পুলিশ বাহিনী তো কোনও নাস্তিকের জন্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। পর পর আরও ক'জন নাস্তিককে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের রক্তের ওপর ইসলামের বিজয় নিশান সেই যে ওড়ানো হয়েছে , এখনও উড়ছে সেই নিশান। আমার সোনার বাংলার নিশান!