চামড়া শিল্পে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হোক
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। প্রতিবছর ত্যাগ ও ভালোবাসার অমিয় শিক্ষা নিয়ে লাখো পশু কুরবানি দেন বাংলাদেশের কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ। যুগ যুগ ধরে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কুরবানি কৃত পশুর চামড়ার মূল্য গরিব-মিসকিন, এতিমখানা, মাদ্রাসা ও সমাজের দুস্থদের দান করে আসছে। অথচ গত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে বিরাজ করছে সিন্ডিকেটের কালো থাবা।
বাংলাদেশের পশুর চামড়া সংগ্রহের সিংহভাগ সংগ্রহ করা হয় কোরবানির মৌসুমে। কিন্তু খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পের কতিপয় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি শুরু করে। অস্বাভাবিক হারে দাম কমে যায় কুরবানিকৃত পশুর কাঁচা চামড়া। কম দামে কাঁচা চামড়া কিনলেও দেশীয় বাজারে চামড়াজাত পণ্যের কিন্তু দাম কমেনি। বরং বছর বছর দেশে বৃদ্ধি পেয়েছ চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা ও দাম।
কয়েকবছর আগেও লাখ টাকা দামের একটি গরুর কাঁচা চামড়া কম করে হলেও কোরবানির সময়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। পশু কুরবানির পরপরই মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা ছুটে যেতেন কোরবানি দাতাদের কাছে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য। দরদামের মাধ্যমেই সানন্দে সর্বোচ্চ মূল্যে চামড়া বিক্রি করে, সে অর্থ দান করতেন কুরবানদাতারা। এ অর্থের মাধ্যমে দেশের দরিদ্রশ্রেণি এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো উপকৃত হতো।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট পুরো উল্টো। লাখ টাকার গরুর চামড়াও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৫০০ টাকার বেশি দাম দিতে রাজি নয়। অযুহাত হিসেবে আড়তদারদের দোষারোপ করেন তারা। অন্যদিকে আড়তদাররা দোষারোপ করেন ট্যানারি মালিকদের। ফলশ্রুতিতে, লাখ লাখ বর্গফুটের পশুর চামড়া বিক্রি না হতে হতে নষ্ট হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। গতবছর দেশের চামড়া বাজারে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
কোরবানদাতারা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়ার প্রকৃত দাম না পেয়ে অনেকসময় চামড়াকে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন; আবার কিছু চামড়া জলাশয়ে ফেলেছেন। এরফলে, একদিকে নষ্ট হয়েছে আমাদের পরিবেশ; অন্যদিকে নষ্ট হয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চামড়ার মূল্যে উপর নির্ভর করা দেশের গরিব মানুষ এবং এতিমখানার অসহায় শিশুরা।
চামড়ার এমন দরপতন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ গণ্যমাধ্যমেও বিভিন্ন খবর ও লেখালেখি হয়েছে। এমন দরপতন কি যৌক্তিক কারণেই হয়েছে নাকি অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এমন দরপতন? প্রকৃতপক্ষে চামড়া বাজারে এমন দরপতনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করতে গেলে বেশকিছু বিষয় সামনে চলে আসে।
চামড়ার এমন দরপতনের পেছনে বেশকিছু সিন্ডিকেট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। প্রতিবছর কোরবানির সময় এলেই সক্রিয় হয়ে উঠে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীদের এ সিন্ডিকেট। কোরবানিকৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ থেকে ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাত বদল হয় একটি পশুর চামড়া। সিন্ডিকেটগুলো এ হাত বদলের জায়গাগুলোতে তাদের কারসাজি শুরু করে।
পরিকল্পিতভাবে বাজারে চামড়ার কৃত্রিম চাহিদা না থাকার গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে আড়তদাররা, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নায্যমূল্যে চামড়া কিনতে ইচ্ছুক থাকে না। অন্যদিকে, আড়তদারদের কাছ থেকে কম মূল্যে চামড়া বিক্রি করার ভয় থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কম দামে চামড়া কেনার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সরকার কতৃক নির্ধারিত দামকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অসাধু চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কালো থাবায় ধ্বংসের পথে দেশের ২য় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের খাতটি।
চামড়া বাজারে এমন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দেশের চামড়া শিল্পের জন্য মোটেই আনন্দের খবর নয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোভের বলি হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প। চামড়ার দামের এমন অব্যাহত পতন এবছরও চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কোরবানদাতারা আর চামড়া বিক্রি করতে আগ্রহী হবেন না। ফলশ্রুতিতে, চামড়ার যোগানের সংকটের মুখে পড়বে দেশীয় চামড়া শিল্প।
এতে করে, একদিকে ট্যানারি মালিকদের উৎপাদন কমাতে হবে, অন্যদিকে চাকরি হারাবে এ শিল্পে কর্মরত হাজারো শ্রমিককে।
কোভিড-১৯ সংকটময় পরিস্থিতিতে উদাযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। দীর্ঘদিন লকডাউন ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে গতবছরগুলো থেকে এবছর তুলনামূলকভাবে কম কোরবানির পশু জবাই হয়েছে। সরকারের পুনঃনির্ধারিত চামড়ার দাম গত বছর থেকে প্রায় ২০ শতাংশ কম। গতবছর ঢাকা শহরের ভিতরে লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য ছিল ৪৫-৫০ টাকা এবং ঢাকার বাহিরে ৩৫-৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এবছর ঢাকা শহরে ৩৫-৪০ টাকা ও ঢাকার বাহিরে ২৮-৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চামড়ার বিক্রি অর্থ যেহেতু সমাজের অসহায় এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে বেশি ব্যয় হয়, সেজন্য চামড়ার নায্যমূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কোরবানীর মূল শিক্ষাই হল সকল প্রকার ঠুনকো, খোঁড়া যুক্তি ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর হুকুম আহকামের প্রতি পূর্ণ আত্মসমার্পণ করা। নিজের মনের ভিতরে থাকা লোভ-ললসা ও পশুত্বকে আল্লাহর সন্তুষ্টি জন্য ত্যাগ করাই কুরবানির প্রধান উদ্দেশ্য। চামড়া শিল্পের অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কোরবানির শিক্ষাকে ধারণ করতে হবে। নিজেদের লোভ-লালসার কারণে দেশীয় শিল্প ধ্বংস মোটেই ইসলামি বিধি-সম্মত নয়।
তাছাড়া, কোরবানিকৃত পশুর চামড়ার মাধ্যমে মাদ্রাসা, এতিমখানা ও সমাজের দরিদ্র শ্রেণি উপকৃত হয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়ার দাম কমিয়ে এদের হককে বিনিষ্ট করা মোটেই উচিত নয়।
সরকারকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। ঈদের আগে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেই নিজেদের দায়িত্বকে শেষ করা যাবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নায্যমূল্যে চামড়া বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কালো হাত ভেঙ্গে দিতে হবে। অসাধু ও লোভী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাত থেকে চামড়া শিল্পকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবী।
লেখক, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়