ঈদ কার্ড
ঈদ ঈদ ঈদ! কী মজা, ঈদ এসে গেছে! কারো মনে থাকুক আর না থাকুক বাবা আর চাচ্চু মনে থাকবেই ছোট নাফিয়ার নতুন জামা, মেহেদি আর সাজগোজের জিনিসের সাথে সাথে ঈদ কার্ড লাগবেই। ঈদের সময় মার্কেটের বড় বড় দোকানগুলোতে জামা-কাপড়সহ ঈদ কার্ডও বিক্রি হয়। তবে নাফিয়া রমজানের শুরু থেকেই টাকা জমানো শুরু করত পাড়ার গলির কেষ্টদাদুর দোকান থেকে ঈদ কার্ড কিনবে বলে।
দাদুর দোকানের সেই ঈদ কার্ডগুলো কতই না সুন্দর। জরি বসানোর কার্ডগুলো শুধু কেষ্ঠদাদুই বিক্রি করতেন। বাবার আনা কার্ডগুলো নাফিয়া কাউকে দিত না, খুব কাছের সই অপিকে ছাড়া। আর কেষ্টদাদুর দোকান থেকে কেনা কার্ড সবাইকে দিত। সাথে সাথে দাদুর দোকানে রঙিন কলমগুলোর জন্য বড় উৎসাহে থাকত নাফিয়া।
কেষ্টদাদুও নাফিয়াসহ পাড়ার সব ছোট বাচ্চাগুলোর আবদারে তার মুদির দোকানে ঈদ কার্ড আর সেই রঙিন কলম আনত বিক্রির জন্য।
রমজান মাস শুরু হয়েছে। নাফিয়া প্রতিবারের মত টাকা জমাতে শুরু করেছে, এবার একটু বড় হয়েছে সে আর বায়না ধরেছে এবার সে তিনটি জামা নিবে সাথে সাজুগুজুর জিনিসের বিশাল একটা লিস্ট। চাচ্চু যখন ছাত্র ছিল টিউশনির টাকা দিয়ে নাফিয়ার বায়নাগুলো পূরন করত। এবার চাচ্চু ডাক্তারি পাশ করেছেন। নাফিয়া চাচ্চুর কোলে চড়ে উঠে বললো, আমার এবার অনেক কিছু চাই। চাচ্চু মুচকি হেসে বললো সব হবে, ‘‘আমার ছোট মা বলে কথা”।
বাবা-চাচ্চু সবাই এবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নাফিয়ার স্কুলও বন্ধ হবে ১/২ দিনের মধ্যে। মনটা ভারি হয়ে গেছে। কেষ্টদাদুও দোকান খুলছে না। অপি বললো, জানিস নাফিয়া দাদুর নাকি বড় অসুখ করেছে। শুনেই নাফিয়ার মন খারাপ। তবে এবার কী তার কার্ড দেয়া হবে না। ঈদের কার্ডে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে নাফিয়া বন্ধুদের ঈদ মোবারক জানায়, বন্ধুদের দাওয়াত দেয়।
রাতে খাবার টেবিলে নাফিয়া চুপ করে বসে আছে। রোজ তার আবদার থাকে এটা নেবে, ওটা নিবে ঈদে। এখানে ঘুরবে ওখানে ঘুরবে। তবে আজ চুপ করে বসে আছে। বাবা মাকে ডেকে বলল, কী হয়েছে আমার মামুনিটা? কাল আমার ছুটি। সবাই মিলে শপিংয়ে যাবো। তবুও চুপ করে আছে নাফিয়া।
চাচ্চু বাসায় দেরি করে ফিরছে। এসেই শুনে নাফিয়ার মন খারাপ। রুমে গিয়ে দেখে টেবিল পাশের সেই চেয়ারটিতে একা বসে আঁকিবুঁকির করছে। কোলে নিয়ে বলল কি হয়েছে নাফিয়া মনির। নাফিয়া কেঁদে দিল। কেষ্টদাদুর নাকি অসুখ করেছে তাই দোকান খুলেনি আমার ঈদ কার্ড কেনাও হয়নি। চাচ্চু বললো তাতে কি কাল সবাই মিলে মার্কেটে গিয়ে আগে ঈদ কার্ড কিনব।
পরদিন সবাই মিলে মার্কেটে গেলো। কার্ডের দোকানে গিয়ে চুপসারে তাকাচ্ছে চারদিক একটা কার্ডও পছন্দ হয় না তার। বারবার কেষ্ট দাদুর কথা মনে পড়ে। মন খারাপ দেখে সেদিন আর কিছু কিনা হল না কারো। নাফিয়া আগের মত বায়না করছে না। মন ভার করে থাকে। চাচ্চু নাফিয়াকে কোলে নিয়ে কেষ্ট দাদুর বাসায় গেলো। গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে কেষ্টদাদু পাশে তার মা মরা মেয়ে বসে আছে। অনেক জ্বর।
চাচ্চু সদ্য ডাক্তার হয়েছে। কেষ্ট দাদুকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করল। বড় অসুখ করেছে অনেক টাকা লাগবে। এ শুনে ব্রাহ্মণ কেষ্টদাদুর মেয়ে কেঁদে দিল। ভিটে বাড়ি আর দোকানটা ছাড়া কিছু নেই তাদের বাবার অসুখের জন্য দোকানটাও বন্ধ। নাফিয়া মা-বাবা আর চাচ্চুর কথা আড়ি পেতে শুনছিল। নাফিয়ার জমানো টাকার ব্যাংকটা ভেঙ্গে কাঁচা পয়সা আর টাকা মিলে ১২০টাকা চাচ্চুর হাতে দিয়ে বলল এই নাও এই টাকাগুলো আর এবার ঈদের জন্য জামা কেনার টাকা দিয়ে দাদুকে সুস্থ করে আনো।
বাবা অবাক হয়ে গেলো ছোট নাফিয়ার কান্না দেখে। চাচ্চুর হাসপাতলের সবাই আর পাড়ার সবার টাকা একত্রে করে কেষ্টদাদুর চিকিৎসা হলো। এবার ঈদে নাফিয়া অপি এলাকার পিচ্চিগুলো কেষ্টদাদুর বাসায় কাটিয়েছে দাদুর সাথে খেলা করে। হিন্দু ব্রাহ্মণ কেষ্টদাদুর বাসায়ও এবার ঈদের সেমাই রান্না করেছে তার মেয়ে।
নাফিয়া বিদেশে গেছে এবার নাকি ঈদে বাড়ি ফিরবে। অনেক বড় হয়েছে। পড়াশুনা শেষ। বাসায় ফিরেই কেষ্টদাদুর কথা জিগাসা করল। তার কেষ্টদাদু কেমন আছে। এত বছরও মনে পড়েছে তবে খোঁজ নেয়া হয়নি। কেষ্টদাদুর বাড়ি দিক গেলো দেখে দাদু এক মাদুরি পেতে বসে খবরের কাগজ পরছে। নাফিয়া দৌড়ে গিয়ে প্রনাম করে বলল, ও দাদু কেমন আছো?
দাদু চশমাটা উঁচু করে দেখে নাফিয়া। তাকে দেখে আনন্দের সাথে হাসি দিয়ে দাদু বলল, তুই আর মরতে দিলি কই। দাদু বললো, দাঁড়া তোর জন্য কিছু জিনিস রেখেছি, আজ বাদে কাল ঈদ। অনেক বছর পর আসলি তোর উপহারগুলো নিয়ে যা। নাফিয়া দেখে দাদু অনেকগুলো কার্ড তার হাতে ধরিয়ে দিল। এইনে এতো বছর আসিস নি তো। তাতে কি জমা রেখেছি তোর জন্য। তার মধ্যে কিছু কার্ড দাদুর হাতের বানানো।
দাদু বলল, আমি বানিয়েছি রে তোর জন্য আজকাল তো ঈদের কার্ড পাওয়া যায় না। বাচ্চা বুড়ো সব নাকি কী সব ফোনে মেসেজ লিখে। আর হ্যাঁ ঈদের দিন কিন্তু আসবি তোর পিসি তোর জন্য প্রতি ঈদে পায়েস, সেমায় রাঁধবে। পূজার সাথে সাথে ঈদেও ভালো মন্দ রান্না করে তোর পিসি। এবারও ঈদে নাফিয়ার চোখ ছলছল করছে ছোটবেলার সেই দিনগুলো কথা মনে করে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক