পঁচাশির চলচ্চিত্র ‘দহন’ ও বর্তমান ভঙ্গুর সমাজের ক্রন্দন
দহন। ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্র। ছবিটি তিনটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং দশটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। আমি প্রধান চারটি চরিত্রের নাম উল্লেখ করছি। বুলবুল আহমেদ, হুমায়ুন ফরিদী, ববিতা এবং আসাদুজ্জামান নূর।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে এক শিক্ষিত বেকার যুবক মুনির (হুমায়ুন ফরিদী)। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় থাকেন। সিনেমায় দেখানো হয়েছে কীভাবে রাজনীতির যাঁতাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পিষ্ট হয়, নৈতিকতার অভাবে সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার কাঠামো বিনষ্ট হয় এবং সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অভাবে বেকারত্ব সৃষ্টি হয়।
মুনিরের চাকরি নেই। টিউশন করে বাড়ির বাজার সামলে নেয়। চাকরি না পেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ধরা পড়ে এক অসাধুর হাতে। এই জায়গায় সম্পূর্ণ নৈতিকতার অভাবে মানুষ কত বড় নিমকহারাম হতে পারে তা দেখানো হয়েছে।
মুনির মাঝেমধ্যে পত্রিকায় কলাম লিখেন। একদিন এক আর্টিকেল নিয়ে পত্রিকার অফিসে যান। ‘মানুষ খাবেনা’ বলে তার লেখা ফেরত দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন মানুষ সেক্স, ভায়োলেন্স, ক্রাইম ছাড়া লেখা পড়েনা। তিনি আলোকপাত করেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের আপোষমুখী মনোবৃত্তি সমাজের বৈষম্য আর অপরাধ প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে।’
আজকে আমাদের সমাজের দিকে তাকালেও ঠিক একইরকম চিত্র ভেসে উঠে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদেরকে উচ্চবিত্ত ভাবতে পছন্দ করেন। বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক পাণ্ডা হয়ে গেছেন। রাজনৈতিক মতবাদ কায়েমে সচেষ্ট। রাজনৈতিক কায়দায় বুদ্ধিকে রুজি করেই বাঁচতে চান। সমাজের সুষ্ঠু কাঠামো বিনির্মাণে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
মুনিরের আর্টিকেলে যে বিষয়টি রিফ্লেক্ট করেন তা হলো- ‘উচ্চবিত্ত ধনীক শ্রেণী বিদেশ থেকে আধুনিক টেকনোলজি আমদানির সাথে সাথে আমদানি করে অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতি আমদানির পেছনে কাজ করে তাদের বিকৃত রুচিবোধ। নৈতিকতার পরিবর্তে তারা নিয়ে আসে আমোদ প্রমোদের সস্তা উপকরণ।’
মুনির পরোক্ষভাবে এখানে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি এবং আল্ট্রা মডার্নিজমকে ভঙ্গুর সমাজের জন্য দায়ী করেছেন। আসলেই কি ওয়েস্টার্ন কালচার আমাদেরকে ফাস্ট করেছে? তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিলেও মোরালিটিতে অনেক জোরেশোরে আঘাত করেছে। যে ধাক্কা সেরে উঠতেও আরো কয়েক যুগ লেগে যাবে।
অপরদিকে রাজনীতি নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ জুড়ে দেন তার মামা। তিনি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি নিয়ে অতীত আর বর্তমান তুলনা করেন। আগেকার রাজনীতি ছিলো দেশের জন্য, সামষ্টিক অগ্রসরতার জন্য। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় স্বার্থ ভুলে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া সমাজপতিরা গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়।
মামা বলেন, ‘‘আরে বাপু রাজনীতি করবি মানুষের উপকারের জন্য, দেশের জন্য। তা নয়। সবাই করছে নিজের জন্য। ঐ ত্যাগ-ব্যাগ না করলে দেশ সেবা হয় না। বুঝলি রাবেয়া। সততা, নিষ্ঠা-ফিষ্টা মানুষের মধ্যে না থাকলে রাজনীতি হয় না। এই পোড়া দেশে সৎ মানুষের বড় অভাব। …’’
আমরা দেখতে পাই নৈতিকতা পৃথিবীর কোন বিজ্ঞান, সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়না। নৈতিকতা শিখতে হলে ধর্মের পায়ে ধরনা দিতে হবে। কিন্তু পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি সমাজ বস্তুবাদের দিকে ঠেলে দিয়ে রক্ষণশীলতা, চেতনা এবং বিশ্বাসকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। আমাদের সমাজে সন্তান বাবাকে সম্মান করে, বড়দের শ্রদ্ধা করে, ছোটদের স্নেহ করে, মুরুব্বীদের সালাম দেয়। আমাদের আলাদা করে বাবা দিবস, মা দিবস পালন করতে হয়না।
অপরদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতায় ঘটা করে মা দিবস, বাবা দিবস পালন করতে হয়। কারণ তাদের পরিবার কাঠামোই ভঙ্গুর। ছোটোবেলা থেকেই দেখছে মা বাবা আলাদা। পরিবারে সমস্যা লেগেই আছে। কিন্তু আমাদের সমাজেও এই সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজপতিরা বাইরে থেকে প্রযুক্তি আনতে গিয়ে অপসংস্কৃতি নিয়ে আসছে যা আমাদের তরুণ সমাজকে রেস্টলেস করে দিচ্ছে। যার দরুণ অপরাধের পুনরাবৃত্তি হয়। আজকাল আমরা নৈতিকতার প্রশ্নে ধর্মকে অবমাননা করছি। সে, যে ধর্মই হোক।
পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমরা যান্ত্রিক আর নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। বিজ্ঞান আমাদের প্রয়োজন আছে। তবে এটাও ঠিক যে বিজ্ঞান আমাদের নৈতিকতা শেখাতে পারেনা। বিজ্ঞান একজন মানুষকে শুধু মানুষ বলতে পারে। স্পেসিফিকেলি ভাই, বোন, মা, বাবা, মামা, খালু এসব পরিচয় করিয়ে দিতে পারেনা। এই প্রশ্নে আমাদের ধর্মের কাছে যেতে হবে।
সুতরাং ধর্মীয় মূল্যবোধ ফিরে না আসা পর্যন্ত এই সমাজ ভাঙতেই থাকবে। সমাজ গড়তে হলে ধর্মের কাছে গিয়ে নৈতিকতা শিখতে হবে, বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতে হবে। অন্যথায়, কালো গহব্বরে পতিত হবে মানবসভ্যতা, থামানো যাবেনা সমাজের ক্রন্দন এবং শেষ হবেনা এই দ্বান্দ্বিক দহন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়