১৪ জুলাই ২০২০, ১১:৫৫

করোনা-দুর্যোগ ও শিক্ষা সংকট

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  © ফাইল ফটো

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গোটা বিশ্বেই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের করোনা-দুর্যোগ চিত্র আমরা সংবাদ-মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। আমাদের সার্বিক পরিস্থিতিও নাজুক। আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ আমাদেরও নানা খাতে এই দুর্যোগের যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন। উদ্বেগের বিষয় হলো- দিন দিন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। তার পরও আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীন কর্মকাণ্ডের চিত্র। এর মাঝে আবার সংবাদমাধ্যমেই উঠে আসছে নানারকম অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র।

করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ চিত্র, অনিয়ম-দুর্নীতির অপচ্ছায়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ফের চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দায়িত্বশীল অনেকেরই ব্যর্থতা-অদূরদর্শিতার বিষয়গুলো সামনে নিয়ে এসেছে। এর ওপর নানারকম (প্রকৃত কাজে মনোযোগ না দিয়ে) অর্থহীন কথাও শুনি দায়িত্বশীল অনেকের মুখেই। এত সংকটের মাঝে কী করে নিরুদ্বিগ্ন থাকা যায়! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফের হুঁশিয়ারি দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় সব দেশের প্রতি পদক্ষেপ দ্বিগুণ জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক আরও কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। এগুলো আমলে রাখা প্রয়োজন।

করোনা-দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব পড়েছে আমাদের শিক্ষা খাতেও। এই খাতে বিরূপ প্রভাব কতটা প্রকট রূপ নিয়েছে এরও ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে করার প্রয়োজন নেই। শিক্ষা সংশ্নিষ্ট সবাই তো বটেই অভিভাবকদের পর্যন্ত নানা রকম শঙ্কাগ্রস্ত করেছে বিদ্যমান পরিস্থিতি। এমনিতেই আমাদের সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য একটি বড় নেতিবাচক বিষয়। সামাজিক নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য যেমন বিরাজমান তেমনি শিক্ষা খাতও এর বাইরে নয়। যে রাজনীতি জন-অধিকারের নিরিখে পরিচালিত হওয়ার কথা সেই রাজনীতিও বৈষম্যমুক্ত নয়। যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বৈষম্য আরও বেশি নেতিবাচকতার সৃষ্টি করে। এই নেতিবাচকতাও আক্রান্ত করে মানুষকে।

আমাদের শিক্ষা খাতে অধিকার ও বৈষম্যের বিষয়গুলো ঘুরেফিরে আলোচনায় আসেই। আমাদের নানা ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে তা অসত্য নয়; কিন্তু এর পাশাপাশি এও সত্য উন্নতির হাত ধরেই বেড়েছে বৈষম্যও। শ্রেণি সমস্যা তো পুরোনো বিষয় হয়েই রয়েছে। করোনার আক্রমণ ধরিয়ে দিল, আমাদের সব উন্নতির সমান্তরালেই অন্ধকার যেমন আছে তেমনি শূন্যতাও আছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে তা বেশি হারে দৃশ্যমান। শ্রেণিবৈষম্য যদি আমরা দূর করতে না পারি, রাজনীতির ক্ষেত্রে যদি এটাকে মূল প্রশ্ন- হিসেবে ধরে নিয়ে রাজনীতিকরা ব্রতী না হন তাহলে আমাদের মুক্তির পথ কণ্টকমুক্ত হবে না। করোনা নানামুখী ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা খাতে যে ক্ষতি করেছে বা আরও করবে তা থেকে উত্তরণ আমাদের সহজ হবে না।

ধনী-গরিব প্রায় সব দেশই কমবেশি করোনা আক্রান্ত। তবে ধনী দেশগুলো ফের ঘুরে দাঁড়াতে হয়তো খুব একটা সময় নেবে না; কিন্তু গরিব কিংবা আমাদের মতো দেশগুলোকে নানারকম প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা মুখোমুখি হতে হবে অত্যন্ত কঠিনভাবেই। যূথবাজ প্রয়াসে এই সংকট দূর করতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দলে দলে পুরোনো সংঘাত ঘুচিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। মানুষের মনে করোনা-দুর্যোগ ভয়াবহভাবে হতাশা-আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীদের মনে এর অপচ্ছায়া আরও বেশি বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষ করে গৃহবন্দি শিশু শিক্ষার্থীরা মানসিক বিষাদে বেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমেই এসেছে। তাই শিশু, তরুণ, তরুণী, কিশোর, কিশোরীদের ওপর মনোযোগ বিশেষভাবে বাড়াতে হবে। এর মধ্যেই সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানের চর্চাকে উৎসাহিত করা দরকার।

শুনতে খারাপ লাগলেও কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, শিক্ষাটা চলে গেছে যেন হাটে-বাজারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার যথাযথ স্থান হলেও এক্ষেত্রে বাণিজ্যের আগ্রাসন (কোচিং, নোট-গাইডের ওপর নির্ভরতা ইত্যাদি নেতিবাচকতা) মেধা বিকাশে বড় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। নিকট অতীতে এসএসসির ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের অনেকেরই দৃষ্টি এমনকি ব্যবস্থাপনারও দৃষ্টি যেন পাসের হারের দিকে; মানের দিকে নয়। এই যে বললাম শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কথা, তাতে পাসের হার হয়তো বাড়ছে, কিন্তু মান কি বাড়ছে? বিকাশ ঘটছে কি প্রকৃত জ্ঞানের? আমরা যেন ভুলে না যাই জ্ঞানই শক্তি।

পাসের হার বৃদ্ধি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, মান বৃদ্ধি ততধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পর্যায়েই মান ক্রমাগত বাড়ানোর তাগিদ থাকে এবং অবশ্যই মনে রাখা দরকার এক্ষেত্রে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশই নেই। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক ফাঁক-ফোকর রয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এই ফাঁক-ফোকর বন্ধ করে দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের বিকাশমান ভবিষ্যৎ। কাজেই মান বৃদ্ধিতেই নজর বাড়াতে হবে। এসএসসি পরবর্তী ধাপগুলো যাতে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্পন্ন করতে পারে, নজর বাড়াতে হবে সেদিকেও। এবার করোনা-দুর্যোগের কারণে এখনও ভর্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হলেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক যাতে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে।

শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করতেই হবে। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনা-দুর্যোগের কারণে ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। নিকট অতীতে পত্রিকান্তরে প্রকাশ, শিক্ষাব্যবস্থায় কভিড-১৯ মহামারির প্রভাব মোকাবিলা শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই পর্যবেক্ষণ উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার প্রবণতা নতুন নয়। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ঝরে পড়া রোধে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। ঝরে পড়ার বিষয়টি সংশ্নিষ্ট নীতিনির্ধারকদের বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় বিশেষ পরিকল্পনা দরকার।

করোনা-দুর্যোগ উচ্চশিক্ষায় সেশনজটের সংকট আরও প্রকট হতে পারে- এও সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ। আমাদের উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ হলো বিশ্ববিদ্যালয় (বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়)। এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতে এমনিতেই রয়েছে সেশনজট। এর মধ্যে করোনা-দুর্যোগ তা আরও প্রকট করে তোলার আশঙ্কা পুষ্ট করেছে।

আমাদের উচ্চশিক্ষারত শিক্ষার্থীদের কর্মজগতে প্রবেশে বড় বাধা এই সেশনজট। সেশনজট দূর করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাস্তবভিত্তিক কর্ম-পরিকল্পনা নিতে হবে এবং এর বাস্তবায়নে দূরদর্শী পদক্ষেপের বিকল্প নেই। করোনা-দুর্যোগে সব স্তরের শিক্ষার্থীরাই ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে যে ধারা চলমান, প্রযুক্তিগত যত ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, এর বিকল্প কোনো কিছুই এত সহজ নয়। এও মনে রাখা দরকার, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা-সামর্থ্য সিংহভাগ শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের নেই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে।

 

শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক

সূত্র: সমকাল