অ্যান্টিবডি কিট থেকে পাটকল
বেশ অনেকদিন হল আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছি। তারপরও আমার সহকর্মীরা- যারা একসময় প্রায় সবাই আমার ছাত্রছাত্রী ছিল, তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আমি কারণে-অকারণে তাদের ফোন করি, তারাও নিয়মিত আমার খোঁজখবর নেয়। আজকাল জুম-মিটিং নামে এক ধরনের কায়দা বের হয়েছে, সেটি ব্যবহার করে যারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যারা আমেরিকা-কানাডা অথবা ইউরোপে আছে কিংবা যে ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত সন্দেহ করে আইসোলেশনে আছে, তাদের সবার সঙ্গে একত্রে গল্প-গুজব করা যায়।
একাধিকবার আমি সেভাবে তাদের সঙ্গে রীতিমতো আড্ডা দিয়েছি। শেষবার তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার এক ছাত্রী আমাকে জানাল, ‘স্যার, ফেব্রুয়ারি মাসে আমার খুব বিচিত্র একটা অসুখ হয়েছিল- জ্বর, গায়ে ব্যথা, তার সঙ্গে খুবই অদ্ভুত এক ধরনের কাশি। কাশতে কাশতে মনে হতো গলা থেকে রক্ত বের করে ফেলি; কিন্তু একফোঁটা কফ নেই। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে খাবারে বিন্দুমাত্র স্বাদ পাইনি, যেটাই খাই, সব একরকম মনে হয়েছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার একার? নাকি বাসার সবার?’ সে বলল, ‘বাসার সবার। এটি আমার হাজব্যান্ড ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিল।
সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন আমার শাশুড়ি, তার নিউমোনিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। তাই হাসপাতালে নিতে হয়েছিল।’ আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জ্বর নিয়ে ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলে?’
সে মাথা নেড়ে বলল, ‘গিয়েছি। কলিগদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে।’ কলিগ বলতে যাদের বুঝিয়েছে তারাও জুম-মিটিংয়ে আছে। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম তাদের শরীরে তখন কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা।
তারা সবাই বলল, তাদেরও জ্বর-কাশি হয়েছিল; কিন্তু সেটি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়নি। বছরের এ সময় জ্বর-কাশি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বাংলাদেশে থাকবে আর সর্দি, জ্বর, কাশি হবে না, সেটি তো হতে পারে না!
আমরা এখন যেসব উপসর্গকে করোনার ক্লাসিক উপসর্গ বলে জানি, আমার ছাত্রীর উপসর্গ তার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তাহলে আমরা কি সন্দেহ করতে পারি, ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমার সেই ছাত্রী এবং তার পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল? বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না গেলে করোনার উপসর্গ আর সাধারণ সর্দি-কাশি-ফ্লুয়ের উপসর্গের মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই।
তারপরও এটিকে বিচ্ছিন্ন কাকতালীয় একটা ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারি না, তার কারণ আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে তারা যখন জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের উপসর্গের সঙ্গে করোনার উপসর্গ মিলে যায়। তারা অবশ্য সেটি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়নি।
আমি নিজেও জানুয়ারির শেষে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়েছিলাম, ‘শুকনো কাশি’ বলে নতুন একটা অবস্থার সঙ্গে তখন পরিচয় হয়েছিল। জ্বরটির বৈশিষ্ট্য ছিল এক ধরনের অবিশ্বাস্য ক্লান্তি। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। সুস্থ হওয়ার পর এক পার্টিতে সবাই যখন মজা করে কাবাব খাচ্ছে আমি তখন ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছি, ‘এটা কী রেঁধেছে? বিস্বাদ! মুখে দেয়া যায় না।’
এখন সারা পৃথিবীর সবাই বলাবলি করছে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে করোনার কথা জানাজানি হলেও এটি সম্ভবত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে একবার ‘বিশ্বভ্রমণ’ করে গেছে।
ইতালি ও স্পেনে বর্জ্য পানি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি মাসে হাজার হাজার মানুষ বইমেলায় গিয়েছে, সামাজিক দূরত্বের বিপরীত শব্দ হতে পারে, ‘অসামাজিক দূরত্ব’ কিংবা ‘সামাজিক নৈকট্য’। ‘
অসামাজিক দূরত্ব’ কথাটা জানি কেমন অশালীন শোনায়, ‘সামাজিক নৈকট্য’ মনে হয় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা শব্দ! বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ এ সামাজিক নৈকট্যের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। কাজেই এটি মোটেও অস্বাভাবিক নয় যে, আনুষ্ঠানিকভাবে করোনার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগে আমাদের দেশে (কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে) করোনা একবার চক্কর দিয়ে অনেক মানুষকে তাদের অজান্তে আক্রান্ত করে গেছে।
ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা-সন্দেহ করা যায়; কিন্তু যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেয়া হল, আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা মিলে করোনার অ্যান্টিবডি (এবং অ্যান্টিজেন) পরীক্ষার একটা কিট তৈরি করেছেন তখন প্রথমবার আমার মনে হল, আমাদের সন্দেহটা শুধুই সন্দেহ নাকি সত্যি সেটি প্রমাণ করার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি করোনার পরীক্ষা নয়; কিন্তু আগে করোনা হয়েছে কিনা তার একটা পরীক্ষা হতে পারে।
আমি তখন থেকে আশায় বুক বেঁধে আছি যে, এ কিটটি ব্যবহার করার জন্য উন্মুক্ত করা হবে, তখন আমরা সবাই পরীক্ষা করে দেখব আমাদের অজান্তেই কার কার এক দফা করোনা হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশে করোনার অবস্থা বোঝার জন্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার জন্য, এটার ব্যবহার অমূল্য সম্পদ হতে পারে। সবকিছু যত তাড়াতাড়ি অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল এটি মোটেও তত তাড়াতাড়ি অগ্রসর হচ্ছে না।
আমরা সবাই এতদিনে জেনে গেছি, এটা শতভাগ নিশ্চিত পরীক্ষা নয়, সেটা জেনেই আমরা এটা ব্যবহার করতে চাই। তারপরও কেন জানি এ কিটটি আমাদের হাতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছি। অনেক দেশেই কেউ চাইলেই এখন এ পরীক্ষা করাতে পারে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাদের পাশের দেশ।
কলকাতায় পরীক্ষা করে শতকরা ১৪ জনের মাঝে করোনা অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, যার অর্থ কলকাতার জনসংখ্যা দেড় কোটি ধরে হিসাব করলে শুধু সেখানেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হয়ে যায় ২০ লাখ- অবিশ্বাস্য একটা সংখ্যা! এর মাঝে কী শুভংকরের ফাঁকি আছে, নাকি কিছু একটা আমরা এখনও জানি না? আমাদের ঢাকা শহরে কত পাব?
আমি অবশ্য করোনার সংখ্যা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য লিখতে বসিনি, তার জন্য খাঁটি বিশেষজ্ঞরা আছেন। আমি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতে বসেছি। যেদিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. বিজন শীলের নেতৃত্বে এ কিটটি উদ্ভাবনের খবর পত্রিকায় বের হয়েছিল, আমি স্বাভাবিকভাবেই খুব আনন্দিত হয়েছিলাম।
ড. বিজন শীলকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেছিলাম। অনলাইন খবরের কাগজে প্রতিটি খবরের নিচে মন্তব্য লেখার ব্যবস্থা থাকে (কেন কে জানে! আমি কখনও সেগুলো পড়ার চেষ্টা করি না)। ঘটনাক্রমে সেদিনের খবরের পেছনের সেই মন্তব্যে আমার চোখ পড়ে গেল। আমি হতবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম কোনো একজন পাঠক এ পুরো উদ্যোগটা নিয়ে কুৎসিত একটা মন্তব্য করে রেখেছে।
এ দেশের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পত্রিকার কর্মকর্তারা খুবই উৎসাহ নিয়ে চমৎকার একটা খবরের পেছনে কুৎসিত একটা মন্তব্য জুড়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি, তারাও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন; ধরেই নিয়েছেন পাঠকরা কুৎসিত কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসে।
আমি শুধু সম্ভ্রান্ত পত্রিকার অনুমোদিত একটা মন্তব্য দেখেই হতভম্ব হয়ে গেছি, আমাদের চোখের আড়ালে ফেসবুক নামের সেই অন্ধকার গলিতে অসংখ্য মানুষ কত রকম অশালীন কুৎসিত মন্তব্য না জানি করেছিল, যেটি আমি চিন্তাও করতে পারি না।
এটাই শেষ নয়, কয়েকদিন আগে আমি খবরের কাগজে দেখেছি আমাদের দেশের একটি প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন বের করা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। পশুর ওপর প্রাথমিক পরীক্ষা করে তারা ইতিবাচক ফল পেয়েছে।
দেশের কেউ কিছু করলে স্বাভাবিকভাবেই আমি নিজের ভেতর অনুপ্রেরণা অনুভব করি, কাজেই এ খবরটা দেখেও আমি খুশি হয়েছি। সারা পৃথিবীর অনেক নাম না জানা প্রতিষ্ঠান, অনেক ছোট-বড় বিশ্ববিদ্যালয় করোনার ভ্যাকসিন তৈরি নিয়ে কাজ করছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে তার সুদীর্ঘ তালিকা রয়েছে। আমাদের দেশের কোনো গবেষণাগারে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এ নিয়ে গবেষণার কোনো খবর নেই সেটি আমি নিজেই কয়েকদিন থেকে চিন্তা করছিলাম।
কাজেই খবরটা দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম। তবে বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, আমি খবর পেয়েছি এ গবেষক টিমের নেতৃত্বে যিনি আছেন, আসিফ মাহমুদ, তাকে নাকি ফেসবুকে তুলোধুনো করা হচ্ছে। কেন? যারা তাকে হেনস্তা করে অমার্জিত বক্তব্যের বান ছুটিয়েছে, তারা তাদের জীবনে কি ফেসবুকে একটা কুৎসিত স্ট্যাটাস দেয়ার চেয়ে বড় কোনো কাজ করেছে? করার ক্ষমতা আছে? বড় জানতে ইচ্ছা হয়।
যাদের আমাদের দেশ নিয়ে কোনো ভালোবাসা নেই, যারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও দেশের ভালো কিছু দেখতে পায় না, তাদের আমি শুধু করোনার সময়ের কিছু ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিই :
যখন ঘূর্ণিঝড় আম্পান আমাদের উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছিল, তখন উপকূলের প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে রাতারাতি সরিয়ে নিতে হয়েছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রাতারাতি ২৪ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া কতটা কঠিন কাজ, কেউ চিন্তা করে দেখেছে? (পৃথিবীর প্রায় শ’খানেক দেশ আছে যাদের জনসংখ্যা এর সমান কিংবা এর চেয়ে কম!)
তখন একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসানচরের নিরাপত্তার একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে শুরু থেকে ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থার বিরোধিতা করে আসছিল। বিষয়টি নিয়ে আমি বিভ্রান্তির মাঝে ছিলাম, তাদের মাথাব্যথাটা কোথায় আমি বুঝতে পারছিলাম না।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার বিভ্রান্তি দূর করে দিয়েছেন। তিনি একেবারে খোলাখুলি বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশ করে বলেছেন, এখন তারা কক্সবাজারের পর্যটন এলাকায় পাঁচতারা হোটেলে থাকেন; ঘণ্টাখানেকের মাঝে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যান, বিকালের ভেতর আবার পাঁচতারা হোটেলে ফিরে এসে সারা রাত ফুর্তি-ফার্তা করতে পারেন, সেজন্য তাদের রয়েছে মাস শেষে মোটা বেতন। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিলে এ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সেখানে যেতে এবং ফিরে আসতে ঘাম ছুটে যাবে, সেজন্য তাদের এত আপত্তি!
রোহিঙ্গাদের কথাই যদি বলা হবে তাহলে নিশ্চয়ই বলতে হবে, পৃথিবীর বৃহত্তম এ ক্যাম্পে লাখ লাখ রোহিঙ্গা গাদাগাদি করে আছে, সেখানে করোনার মহামারী ছড়িয়ে গেলে কী ভয়াবহ ব্যাপার ঘটবে, সেটা নিয়ে সবার ভেতরে দুশ্চিন্তা ছিল; কিন্তু সেই ক্যাম্পে এখন পর্যন্ত খুবই সফলভাবে করোনার মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এটি কি আমাদের দেশের জন্য একটি অসাধারণ ঘটনা নয়?
করোনার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনও বের হয়নি। কিন্তু যখনই কিছু একটা সফল পদ্ধতি বের হয়েছে আমরা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে সেটার বাস্তবায়ন হতে দেখেছি। এখন দেশে করোনা থেকে আরোগ্য হওয়া মানুষের প্লাজমা নিয়ে চিকিৎসা প্রায় রুটিনমাফিক হচ্ছে। রেমডেসিভির নামে একটা ওষুধ কার্যকর বলে প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানি সেটি তৈরি করতে শুরু করেছে।
যুক্তরাজ্যের এনএইচএস যখন গবেষণা করে ঘোষণা দিল ডেক্সামেথাসন নামে একটা স্টেরয়েড করোনার জটিল রোগীদের জন্য প্রায় মহৌষধ তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের দেশে এটি খুবই সস্তা একটা ওষুধ।
শুধু তাই নয়, আমাদের ডাক্তাররা অনেকদিন থেকেই জটিল করোনা রোগীদের এটি দিয়ে চিকিৎসা করে আসছেন। কীভাবে কীভাবে জানি করোনার চিকিৎসা নিয়ে দেশের মানুষের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে, আমার পরিচিত যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়, আমাদের দেশে বিভিন্ন মাত্রার পিপিই তৈরি হয়েছে এবং বিদেশে রফতানি হয়েছে। ড. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১০০ সিটের একটা ফিল্ড হাসপাতাল শুধু তৈরিই হয়নি, সেখানে রোগীদের চিকিৎসাও হচ্ছে (সেদিন খবরে দেখলাম, চট্টগ্রামে পরপর দু’দিন কেউ করোনায় মারা যায়নি!)।
‘পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ’ নামে আমার একটা প্রিয় সংগঠন বহুজনকে নিয়ে সারা দেশের জন্য অক্সিজেন ব্যাংক তৈরি করেছে, বাসায় চিকিৎসা করার সময় অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে অক্সিজেন নেয়া সম্ভব।
কী সুন্দর একটি উদ্যোগ! আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক নানা ধরনের মেডিকেল যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন, সেগুলো ব্যবহারও হচ্ছে। এসব খবর শুনে কি একটুখানি প্রশান্তি অনুভব করা যায় না?
তার বদলে কেন জ্বালা অনুভব করব? কেন ভালো একটা খবর পড়ে সুন্দর একটা কথা বলব না? কেন উৎসাহ দেব না? কেন তাচ্ছিল্য করব? টিটকারি করব?
ছোট করার চেষ্টা করব? যারা এগুলো করে আনন্দ পায়, তাদের বলব একবার একটা সুন্দর কথা বলে দেখতে, তখন নিজের ভেতর কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব হয়, সেটা দেখে তারা নিজেরাই অবাক হয়ে যাবে। আমি প্রয়োজনে কোনো কিছু সমালোচনা করতে নিষেধ করছি না; কিন্তু সেটি সমালোচনা হতে হবে, গালাগাল, খিস্তি হতে পারবে না।
সারা পৃথিবীতে অর্থনীতি নিয়ে চলছে আতঙ্ক, আমরাও আতঙ্কিত। ধরেই নিয়েছিলাম, প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিটেন্স কমে আসবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়বে।
কিন্তু সেরকম কিছু চোখে পড়ছে না, বরং রেকর্ড রেমিটেন্স, রেকর্ড রিজার্ভের খবর পাচ্ছি। বাংলাদেশে যতজন করোনায় মারা যাচ্ছে, প্রায় তার সমানসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক বিদেশ বিভুঁইয়ে মারা যাচ্ছেন। সেই খবর পড়ে মন ভারাক্রান্ত হয়। আমরা তাদের থেকে শুধু নিচ্ছি, তাদের কিছু দিচ্ছি না ভেবে নিজেদের অপরাধী মনে হয়।
করোনার সময় শুধু যে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো ভালো ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে সেটি সত্যি নয়। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ছাঁটাই করা একটা ভয়াবহ খবর।
ফ্যাক্টরির মালিক-শ্রমিক মিলে একটা বড় পরিবারের মতো হওয়ার কথা, দুঃসময়ে মালিক-শ্রমিক একসঙ্গে কষ্ট করবে; কিন্তু কোনো কোনো মালিক নিজের সম্পদ রক্ষা করার জন্য শ্রমিকদের ছুড়ে ফেলে দেবেন, এটা কেমন করে হয়?
করোনার এ দুঃসময়েও আমরা দেখছি, কোনো কোনো কারখানার শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতার জন্য রাস্তা অবরোধ করে বসে আছে। কেন?
আমরা হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছি সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের যে প্রেসক্রিপশন মেনে এগুলো বন্ধ করা হচ্ছে সেই প্রেসক্রিপশন আমরা অনেক দেশে অনেকবার দেখেছি।
পৃথিবীতে সবাই এখন পরিবেশ নিয়ে সচেতন, তাই সারা পৃথিবীতে পাটের বিশাল চাহিদা। ভারতবর্ষে নতুন পাটকল তৈরি হচ্ছে, আমরা সেই সময়টাতে পাটকল বন্ধ করে দিচ্ছি।
আমি হিসাব মেলাতে পারি না। আমার মনে আছে, বেশ অনেক বছর আগে খুলনায় পাট শ্রমিকরা খুব দুঃসময়ের মাঝে ছিল, তাদের অবস্থাটা সবার চোখের সামনে আনার জন্য খুলনায় একটা লঙ্গরখানা খোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অনেকের সঙ্গে আমিও সেখানে গিয়েছিলাম।
সরকারের রক্তচক্ষু কাকে বলে, আমি সেবার সেটা টের পেয়েছিলাম। মানুষ যখন শুধু একটা সংখ্যা হয়ে যায়, যখন তাদের পরিবার থাকে না, আপনজন থাকে না, আত্মসম্মান থাকে না, ভবিষ্যৎ থাকে না; তখন সেটা খুব একটা কষ্টের ব্যাপার। আমরা সমস্যাগুলোর মূলে কেন হাত দিই না? পাটকলগুলো বন্ধ না করে আধুনিকায়ন করা কি এতই দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার?
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশের পাটকলগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। তার জন্মশতবার্ষিকীর বছরে সেই পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, এ দেশে কেউ তার দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনতে পাচ্ছে না?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও লেখক
সূত্র: যুগান্তর