ক্যাম্পাসের সেই ব্যস্ততম দিনগুলো আবার ফিরে পেতে চাই

সাবিহা খানম একা
সাবিহা খানম একা  © প্রতীকী ছবি

প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর, সেই তো দিনটার কথা ১৭ মার্চ, ২০২০। পুরো ক্যাম্পাস আলোকসজ্জায় সজ্জিত। কেনই বা থাকবেনা দিনটি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ক্যাম্পাসের ৭০০ একর সেজেছে এক নতুন সজ্জায়। সাথে আছে ফিস্টের ব্যবস্থা।

আগের দিন রাতে হলে প্লান করছিলাম কে কী রঙের শাড়ি পড়বো। ডিসিশন ফাইনাল লাল রঙের শাড়ী পড়ছি কাল। সাথে সাথেই আমি নিপুনকে বলে উঠলাম ফিস্টের কুপন কেটেছিস? খালারা নাকি এবার রুমে রুমে গিয়ে কুপন সরবরাহ করছে শুনেছিস তোরা?

নিপুন এবং আশা হতাশ মুখে বলে উঠল, ফিস্ট কি এবার খেতে পারবো? আর আমাদের ভাজ না খোলা শাড়ীগুলো পড়ে ভ্যানে করে গান গাইতে গাইতে হলগুলো দেখতে পারবো? শুনলাম কী এক করোনাভাইরাস এখন আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। বাসা থেকে আব্বু, আম্মু তাড়া দিচ্ছে দ্রুত বাসায় চলে যাওয়ার জন্য।

আশা বলে উঠল তুই আগেই কুপন কাটিস না, ফিস্ট খেলে একসাথেই খাবো আমরা।

সেই একসাথে খাওয়া আর হয়ে উঠল না। পরদিন সকালেই রওনা করলো ওরা বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর আমি দুপুর ৩টার বাসে। ভাবিনি এতগুলো দিন অতিবাহিত করতে হবে! আসার সময় খুব মজাই লাগছিল উফ, যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সপ্তাহে একটানা পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট দিয়ে যেন পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।

অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ৩১ মার্চ ২০২০। রুটিন ও হাতে পেয়েছলাম তাইতো সাথে কিছু শীট, তিন চারটি পরার জামা আর ল্যাপটপটা নিয়ে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে আনন্দে আনন্দে বাড়ীতে এসে পৌঁছালাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এমন দিন আর ফিরে পাবো না নিজেকে সময় দেওয়ায় এটাই পারফেক্ট টাইমিং।

প্রতিদিন রুপচর্চা করবো। ক্যাম্পাসে ক্যান্টিনের ভাত, ডাল, মুরগী খেয়ে চেহারার যে অবস্থা বানিয়েছি এই কয়দিনের ছুটিতে তা ঠিক করে ফেলবো। নেটফ্লিক্সে একাউন্টটা খুলেই নেই নতুন সব মুভি দেখা যাবে। ও হ্যাঁ, স্যার হুমায়ুন আহমেদের কিছু না পড়া বই আছে তাও পড়ে নেব। ক্যাম্পাসে থাকলে ইয়োগাটা কন্টিনিউ করা হয় না সেটাও করে ফেলবো। অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।

ধীরে ধীরে সব হলো। মুভি ফ্রিক হলাম, ঘরবন্দী থেকে গাঁয়ের রঙ দুই শেড বেশি উজ্জ্বল হলো, ইয়োগা করা রোজকার অভ্যাসে পরিণত হলো। না পড়া বই গুলো ও পড়া শেষ হলো। কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাস, আর কত? ঘরবন্দী দশায় আজ কততম দিন সেটি ভাবলেই শিউরে উঠে গাঁ।

আমি চিনতে পারি না আমার প্রাণবন্ত আমিকে। আমি, আমার সেই ব্যস্ততম দিনগুলোই আবার ফিরে পেতে চাই। সকাল ৯টা ২৫ মিনিট হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস, দুপুরের লাঞ্চ ব্রেক, ক্লাসের ফাঁকে সেমিনারে বসা, টারজানের সেই চায়ের আড্ডা, বোরিং ক্লাসগুলো মিস দিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানো, ক্যাফেটেরিয়ার আড্ডা, বিকেলের সেই গোধূলি দেখা!

আর তারপর প্রকৃতির সেই সুনসান নীরবতা, বৃষ্টিস্নাত রাত, সকালে পাখির কিচিরমিচির, পুরান কলার সেই হিজল ফুলের গাছ, এমএইচের রাস্তা, টিএসসির ছাদ, চৌরঙ্গীর পুকুর পাড় সাথে হালকা বাতাস, প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া মূহুর্তগুলি বন্ধুদের গানের সুরে এবং আড্ডায়।

আমি ফিরে পেতে চাই আমার সবুজ নগরকে। কথা দিলাম এবার আর অবহেলা নয়। বোরিং লেকচার শোনার ভয়ে হলে ঘুমিয়ে থাকা আমি আর একটি ক্লাসও মিস করবো না। তোমার নগরের প্রতিটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে চাই আমি। প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা উপভোগ করতে চাই, বোরিং লেকচারগুলো কান পেতে শুনতে চাই, হলে এন্ট্রি নেওয়ার সময় নিজ নামের জায়গায় সিনিয়র কোন আপুর নাম লিখে বকুনি শুনতে চাই, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ লাউঞ্জের ট্যালটেলে সেই কফি খেতে চাই, মাঝেমধ্যে জাদুঘর ভ্রমণের মত লাইব্রেরি ঘুরতে না গিয়ে খুব করে লাইব্রিতে পড়তে চাই।

শুধু একবার তুমি ফিরে এসো আমার সুদিন হয়ে। কথা দিচ্ছি, এবার আর কোন লুকোচুরি নয়, নয় কোন অলসতা। তোমার দেওয়া প্রতিটি মুহুর্ত আমি উপভোগ করতে চাই, সবুজের সমারোহে আমি খালি পায়ে হাঁটতে চাই। হে আমার নগর, কথা দিলাম তোমায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ