২৩ জুন ২০২০, ১৮:১০

পলাশীর দিবসের শিক্ষা ও আমাদের করণীয়

মোঃ ফাহাদ হোসেন হৃদয়

২৩ ই জুন, ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধ দিবস। ২৬৩ বছর পূর্বে ২৩ ই জুন পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা বনাম ইংরেজিদের যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত নেমেছিল। সেদিন অস্ত নেমেছিল যে স্বাধীনতা, তাকে আবার ফিরে পেতে ২০০ বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে বাঙালিদের। পলাশীর প্রান্তে নবাবের পরাজয় আমাদের গোটা জাতির জন্য বিরাট বড় শিক্ষা। হতাশাজনক হলেও সত্য, পলাশী যুদ্ধের পরাজয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আজও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। মীর জাফর, উর্মিচাঁদ ও রবার্ট ক্লাইভের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যু হলেও আজও তাদের প্রেতাত্মা এ বাংলার কিছু মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে আছে।

পলাশী যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন, নবাবের পক্ষে ৫০ হাজারের বেশি সৈন্য, কামান, অশ্বারোহী বাহিনী ছিলো। অন্যদিকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ৩৫০০ ইংরেজ সৈন্যবাহিনী । ইংরেজিদের তুলনায় নবাবের সৈন্য, ঘোড়া, কামান সবকিছু বেশি থাকলেও যুদ্ধে অসহায়ভাবে পরাজিত হন নবাব। সেদিন মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, রায়দূর্লভ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো নবাবের সাথে। তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের অধিকাংশ সৈন্য সেদিন নিরব দর্শকের মতো নবাবের পরাজয়কে দেখেছিলো। বাংলার তরুণ নবাব নিজের জীবন দিয়েও বাংলার স্বাধীনতাকে সেদিন রক্ষা করতে পারেননি।

উপনিবেশিক ইংরেজি শক্তির অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার লোভে সেদিন অন্ধ হয়ে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিলো বিশ্বাসঘাতকেরা। সেদিন নবাবের সভাসদ ও সেনাপতিরা তারা সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে আজকে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক শক্তির পরাজয় নয়।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর" কান্ডারী হুঁশিয়ার " কবিতায় পলাশীর যুদ্ধে চিত্র তুলে এনেছেন এভাবে

“কান্ডারী!তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।”

পলাশী যুদ্ধের বিজয় ইংরেজিদের উপমহাদেশে তাদের শক্তিমত্তাকে আরো বৃদ্ধি করে তুলে। ধীরে ধীরে তাদের উপনিবেশ স্হাপন করে গোটা উপমহাদেশ জুড়ে। ইংরেজি শাসকশ্রেণি তাদের শাসনামলে দুর্নীতি, অব্যবস্হাপনা, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে উপমহাদেশের ধনসম্পদ নিজেদের দেশে গড়ে তোলে সম্পদের পাহাড়। সমৃদ্ধ সোনার বাংলা পরিণত হয় দারিদ্র্য কবলিত এক জনপদে।

পলাশী যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিতে গেলে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে জানতে হবে। এককভাবে শুধু মীরজাফর, উর্মিচাঁদ, জগৎ শেঠ, ঘষেটি বেগমের মতো বিশ্বাসঘাতকদের দায়ী করলে চলবে না। তৎকালীন সময়ে, দেশের অধিকাংশ মানুষই শাসকশ্রেণি এর পরিবর্তনের ব্যাপারে উদাসীন ছিলো। জাতির মধ্যে ছিলো না কোন ঐক্যবদ্ধতা।
ফলে, রবার্ট ক্লাইভের সামান্য সামরিক শক্তি ও কূটকৌশলের কাছে বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা।

আমাদেরকে অর্জন করতে হবে জাতীয় ঐক্যের শক্তি। নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদকে ভুলে দেশের জন্য কাজ করতে হবে আমাদের। দেশপ্রেমকে শুধু জাতীয় দিবসগুলো উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সদাসর্বদা আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত রাখতে হবে। প্রিয় জন্মভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের থেকে মুক্ত রাখতে হলে সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক নাগরিক গঠনের লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্হাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে আর কখনো পলাশীর পটভূমি রচিত হবে না এ সোনার বাংলায়। পলাশীর যুদ্ধের পতনের কারণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় বলতে হয়,

“দুর্গমগিরি, কান্তার- মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি- নিশীতে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!”


লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইলঃ fahad.hossain.ridoy@gmail.com