২১ জুন ২০২০, ১৫:২৩

দিল্লীর মসনাদ কি আসলেই বন্ধুপ্রতীম!

মো. ফরিদ উদ্দিন মাসুদ

মরা বন্ধুত্বের অনেক সংজ্ঞা দেখেছি যা ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগও ঘটিয়েছি। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন বন্ধুত্ব একটি অকৃত্রিম বন্ধন এবং এর গুরুত্ব অনেক, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বন্ধু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক কেমন তা ভেবে দেখা দরকার। আমরা যদি সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকার দিকে চোখ রাখি তবে খুব সহজেই বুঝতে পারি, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক কতটা শীতল!

গেল বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারত বালাকোটে যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালালো তাতে স্পষ্ট বুঝা যায় পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক কতটা শীতল। ভারত পাকিস্তান দুটি পাশাপাশি দেশ হলেও বস্তুত তারা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। নেপাল ছিলো একসময় ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু সম্প্রতি এখন আর তাদের মামা-ভাগনে সম্পর্ক নেই। এর প্রমাণ হলো বিরোধপূর্ণ লিপুলেখ এবং কালাপানি অঞ্চলের নেপালে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে। নেপাল বলছে এটা করা হয়েছে ১৮১৬ সালের সাউগিল চুক্তি অনুসারে যা ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে বলার কিছু নেই তা সহজেই অনুমেয়।

এবার আসি বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে এটা সবাই কমবেশি স্বীকার করি। কিন্তু তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি না হওয়া, সীমান্তে নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশি হত্যা এবং সর্বশেষ নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কাগজে কলমে ঠিক থাকলেও মননে মগজে শীতল। যার প্রমাণ মিলে গেল বছর বাংলাদেশের তিনজন মন্ত্রীর ভারত সফর বাতিল হওয়া দিয়ে। বস্তুত ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সমপর্ক মোটেও সুখকর নয়।

এবার আসি ভারতের লাভের অংকে। এই সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ভারতের কোনো লাভ হচ্ছে না লাভ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। তিনি ভারতে উগ্রজাতীয়তাবাদী আদর্শ এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন যে তাকে একজন পাকা অভিনেতা বললেও অতিকথন হবে না। এর ফল তিনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন। তিনি দ্বিতীয় দফায় আরও বেশি ম্যান্ডেট নিয়ে দিল্লির মসনাদে বসেছেন। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যতটা না প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তারচেয়ে বেশি একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তার সংগঠনের বক্তব্য বেশি দিয়েছেন।

লাদাখে গত সোমবার যে সংঘর্ষ হলো সেখানে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অপরদিকে চীনে ক’জন হতাহত হয়েছে তা কেউ জানে না। জানে না বললে ভুল হবে বরং চীনের পক্ষ থেকে জানতে দেয়া হয়নি।

এই সংঘর্ষ থেকে ২০টি ভারতীয় প্রাণ গেলেও নরেন্দ্র মোদি কিন্তু জিতে গেছেন। ভারতীয়রা চীনবিরোধী মনোভাব নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। চীনা পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছে, চীনা অ্যাপস মোবাইল থেকে ফেলে দিচ্ছে। শি চিন পিংয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করছে।এতে করে ভারতে নরেন্দ্র মোদির সমর্থন আরও বাড়বেক। যেমনটা বেড়ে ছিল গত বছর বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরে।

অন্যদিকে চীনা প্রেসিডেন্টেরও জনপ্রিয়তা বাড়বে। সত্যি কথা বলতে- ইমরান খান, নরেন্দ্র মোদি, শি চিন পিং কিংবা নেপালের বর্তমানে চীন ঘেষা সরকারও চায় সবাই প্রতিপক্ষের সাথে শীতল সম্পর্ক ধরে রাখুক তাহলে অন্ততপক্ষে ভ্যালট বিপ্লব ঘটানো যাবে।মাঝখান থেকে মরে যায় ২০জন জওয়ান যাদের কান্নার শব্দ তাদের স্বজন ছাড়া আর কেউ শুনে না।

এবার আসি আমাদের মনোভাব নিয়ে। আমাদের অধিকাংশই দেখি ভারতের সেনা নিহত হওয়ায় একটু উল্লসিত। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আমরা কথায় কথায় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করি, স্বৈরাচারের বিরোধিতা করি কিন্তু ভেবে দেখি না যে একজন স্বৈরাচার হটিয়ে আমরা তার চেয়ে বড় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করছি। আজ আমরা ভারতে মুসলিম নির্যাতনে সরব হই। ভারত মুসলিম নিধন করে বলে ভারত-চীন সংঘর্ষে চীনের পক্ষ নিই কিন্তু একবারও উইঘুরদের কথা ভাবি না।

আমরা বাক স্বাধীনতার কথা বলি কিন্তু চীনের বাক স্বাধীনতা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন করি না। আজ বিশ্ব আমেরিকা বলয় থেকে মুক্ত হচ্ছে তখন আবার চীনা আগ্রাসনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। চীন যে ক্রমেই ধরা ছোঁঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে তার প্রমাণ এই হামলা। চীনের সাম্রাজ্যবাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড। চীনা সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি উদাহরণ হলো তারা প্রতিটি দেশেই বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। সূত্র বলছে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চীনের। শুধু তাই নয় ২৩ টি দেশে ২৩ শ' মার্কিন ডলার সহায়তা দিচ্ছে চীন। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, নেপাল, বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় হাটু গেড়ে বসেছে চীন। ভারতের সমস্যা হলো ভারত উগ্রজাতীয়তাবাদী আর চীন হলো বেশি আগ্রাসী।

ভারত সরে এসেছে মাহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখদের শিক্ষা থেকে আর চীন সরে এসেছে কনফুসিয়াস, লাউযু প্রমুখদের শিক্ষা থেকে। ক্ষমতার লড়াই আগেও ছিলো এখনো আছে। ক্ষমতা হাত বদল করে কিন্তু সাধারণ মানুষেরা নিষ্পেষিত হচ্ছে। বিশ্ব এক মোড়লের আঙ্গিনা থেকে বের হতে না হতেই আরেক মোড়লকে স্বাগত জানাচ্ছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।