১৭ জুন ২০২০, ১৫:২১

ঠুনকো জীবন ও আত্ম উপলব্ধি

ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া  © ফাইল ফটো

মানুষ চাইলেও ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে সবসময় তার নিজের মতো করে স্বপ্ন গুলোকে পূরণ করতে পারেনা। কারণ প্রতিটি জীবন অনিশ্চিত। তারপরও আমাদের স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনা, প্রতিটি মুহূর্তে আমরা একটা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু করোনাকালীন এই মহাদুর্যোগ পুরো পৃথিবীকে আরেকবার নতুন করে শিখিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীটা সত্যিই ক্ষণস্থায়ী। প্রতি সেকেন্ডেই জীবনের মূল্য এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যেকোন বিষয়ই জীবনের মূল্যের কাছে খুবই ঠুনকো।

মানুষ মৃত্যুর আগে যেমন একবার মা বাবা তার সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে চাই, ঠিক তেমনই পৃথিবীর এই বিরূপ দুর্যোগকালে বারবার মনে হয় আমাদের যান্ত্রিক জীবন থেকে আমাদের বের হয়ে এসে আরো একটি বার যদি সম্ভব হতো পুরো পরিবারকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে, ভালোবেসে বসবাস করা যেত। তাহলে কত সুন্দরই না হতো এই পৃথিবীটা। মৃত্যু প্রতিটি মুহূর্তেই সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তারপরও কতনা হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি , লুটপাট। একবারও যদি মানুষ তার নিজের জীবনের উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারত যে ভালোবাসা এবং মায়া- মমতা ঘেরা পৃথিবীটাই আসলে সুন্দর, যেখানে থাকবে পরিবারের ভালবাসা, মা বাবার আদর, যত্ন, মায়া, দাদা দাদি, নানা নানি, চাচা, ফুপু বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা।

প্রতিটি মানুষ যদি একবারও তার আত্ম-উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারতো শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা থেকেই জীবনের স্বপ্ন গুলোকে আমরা অনেকাংশেই পূরণ করতে পারি। অপূর্ণ স্বপ্ন গুলোকে ও আমরা পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি এই ভালোবাসার বন্ধন থেকেই। পরিবার এবং পরিবারের শ্রদ্ধাভাজনদের দোয়া মানুষের জীবনের চলার পথকে করে অনেক মসৃণ এবং সমৃদ্ধ। তাই করোনার এই মহা দুর্যোগ আমাদেরকে বারবারই শেখাচ্ছে ছোট -বড় সবাইকেই পারিবারিক এবং সামাজিক গঠনতন্ত্র মূলক সুন্দর শিক্ষা প্রদান করতে হবে যেন ছোট থেকেই তাদের মধ্যে আত্মপলব্ধি চলে আসে এবং বাকিটা জীবন সবাইকে পরিবারের গুরুজনদেরকে ভালোবেসে, শ্রদ্ধা করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে এই আত্মপলব্ধি হওয়ার সময় চলে এসেছে। প্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে যদি একবারও আমরা তাকায় তাহলেই বুঝতে পারবো জীবন কতটা ভঙ্গুর , যেখানে হাজারো হাতিয়ার ,অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা , সৈন্য-সামন্ত, উঁচু উঁচু দালান কোঠা কোন কিছুই কাজে আসছে না করোনার মতো ছোট্ট একটি ভাইরাস এর কাছে। সবকিছুই যেন দিশেহারার মতো, বড় রাষ্ট্রনায়করা যেখানে তাদের দুঃখ প্রকাশ করেছে, ছাড় না মানলেও প্রতিটি মুহূর্তেই রাষ্ট্রপ্রধানরা চেষ্টা করে চলেছে কিভাবে তার নাগরিকদের সুবিধা, নিরাপত্তা এবং জীবনের স্বাস্থ্যবিধি সুনিশ্চিত করবে। কিন্তু তারপরও আমাদেরকে বুঝে নিতে হবে পৃথিবী আর আগের রূপের নেই, জীবন অনেক ক্ষণস্থায়ী।

পৃথিবীর বদলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হলেও, দিনদিন এটাই অনেকটা স্বাভাবিক এর মত হয়ে উঠেছে। করোনাকালীন এই দুর্যোগে পৃথিবী সেজেছে আবার নতুন রূপে, চারিপাশে সবুজের সমারোহ, বহমান এই সময়ে বদলে গেছে চারপাশ। ঘরের ভেতর ও বাহির। বাড়ির আনাচে-কানাচে নতুন চেহারা। নবরূপে প্রকৃতি ও পরিবেশ, চির কাঙ্খিতরূপে। ভারসাম্য আসছে জীবন ও খাদ্যচক্রে, বাস্তুসংস্থানে। নদী আর সাগরে স্বাভাবিক গুণ ও মানের পানি। কক্সবাজারের বাসিন্দারা মন চাইলে দেখতে পারে ডলফিন এর নাচানাচি, যেন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করেছে সেখানকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে। জল ও মাছে ভরপুর নদী- নালা, হাওড়-বাওড়। কষ্টসাধ্য জীবনটাও যখন নৌকার মাঝি আর জেলেদের সুন্দর করে আর একটি বার বাঁচার আশা জাগায়, তখন মনে হয় পৃথিবী সত্যিই নতুনভাবে, নতুন করে আমাদেরকে বাঁচতে শিখিয়েছে। গাছে গাছে ফুলের সমারোহ, পাখির কিচিরমিচির, মৌমাছি মধু সবই যেন তাদের নিয়মেই চলেছে, শুধু বদলে গেছে মানুষের জীবনযাপনের ধরণ, নিয়মাবলী। শৃঙ্খলা এসেছে প্রতিটি মানুষের জীবনে।

প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচার আশায় সুনির্দিষ্ট দূরত্ব বজায়ের মাধ্যমে মানুষ শিখে গেছে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নতুন করে আর একটি বার বাঁচতে হবে। করোনা কালীন এই দুর্যোগেও থেমে নেই কারোর ই পথ চলা, হোঁচট খেলেও , উঠে দাঁড়ানোর শক্তি এখন মানুষের প্রতিনিয়তই তৈরি হয়ে গেছে। এ যেন প্রতিদিনের সূর্য উদয় হওয়া আর সূর্য অস্ত যাওয়ার ই একটি দৃশ্য আমাদের সমাজে বিরাজ করছে বর্তমানের এই করোনা মহামারীর দিনগুলোতে।

পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবন যাপনে! চাইলেই কেউ কারো সাথে দেখা করতে পারে না। কিন্তু সামাজিক দূরত্বের মধ্যেও মিল-বন্ধন বরং আরও বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জীবনকে করেছে অনেকটাই সমৃদ্ধ এবং ত্বরান্বিত। ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল এর যুগে মানুষ চাইলেই সবাইকে দেখতে পারে, কথা বলতে পারে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিতে পারে আড্ডা, যেখানে নেই কোন বাধা। করোনা কালীন এই দুর্যোগ বরং আমাদেরকে শিখিয়েছে পরিশ্রম,আত্মত্যাগ, সংযমী হওয়া সৌহার্দ্য, ভালোবেসে জীবনকে আরেকটি ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কেউ করোনাই আক্রান্ত হলেই ভয় না পেয়ে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম পালনের মাধ্যমে আমরা চাইলেই এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

সময় সত্যিই অনেক শক্তিশালী, চোখের পলকে সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়, শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু। কিভাবে বস্তুনিষ্ঠ, সত্যবাদী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। তাই সময় কে ভালবেসে প্রতিনিয়ত আমরা স্বপ্ন দেখি বরাবরের মতই একদিন সূর্য উদয় হবে, আর সেই দিনে থাকবেনা করোনার কোন প্রাদুর্ভাব, শূন্যের খাতায় নেমে আসবে করোনা রোগী। আশার আলো জাগবে মনে। করোনা কালীন পুরাতন দিনগুলো আমাদেরকে তখন মনে করিয়ে দিবে সত্যিই তো বেঁচে থাকাটাই যেন অবাক সত্য, এই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের প্রতিটি দিনের চলার পথ হবে আরও সুদৃঢ় এবং আমাদের চিন্তা শক্তি থাকবে সুদূরপ্রসারী যেখানে থাকবে নতুন নতুন স্বপ্ন, আশার আলো এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার কোন এক গল্প।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।