১৪ জুন ২০২০, ২১:৩২

কে এই শিক্ষক?

  © টিডিসি ফটো

আমি কি ক্ষুব্ধ, নাকি বিপর্যস্ত? শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর নিউজ দেখে যাচ্ছি, কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। লিখতে পারছি না কিছুই। এতো হতভম্ব হইনি বোধ হয় কখনই। চরম শত্রুর মৃত্যুর পরও বোধ হয় কেউ এমন উল্লাস প্রকাশ করেনি যা করে দেখালো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক।

বঙ্গবন্ধুর খুনি বা রাজাকারদের ফাঁসিতে আমরা আনন্দ মিছিল করেছি, জাতি হিসেবে আমাদের পাপমুক্তির আনন্দে। কিন্তু এই শিক্ষক ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে দায়িত্ব পালনকারী জাতির সূর্যসন্তান বিয়োগে উল্লাস প্রকাশ করে কি বঙ্গবন্ধুর খুনি বা রাজাকারদের ফাঁসিতে আমাদের উল্লাসের প্রতিশোধ টানতে চাইছে?

অন্যথায়, ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করা এই শিক্ষক কী করে ১৪ দলের মুখপাত্রের মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করে? কিসের এতো রাগ ১৯৯৯-২০০১ মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী অন্যতম সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর? কিসের এতো খেদ ওয়ান ইলেভেন ক্রাইসিসে নির্মমভাবে নির্যাতিত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় চার নেতার এক নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী তনয় মো. নাসিমের উপর?

ফেসবুকে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। এটা আসলে ভুল নাকি অপরাধ?

কে এই শিক্ষক?

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র বর্মন দম্পতির ঘনিষ্ঠতম ছাত্রী হিসেবে ভ্যানগার্ড পত্রিকা বিক্রির সুবাদে শিক্ষকদের চেম্বারে চেম্বারে যাতায়াত ছিল তৎকালীন ছাত্র ফ্রন্ট নেত্রী হিসেবে জ্ঞাত এই শিক্ষকের। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি জানতে পারে যে, বিগত চার বছরে ১ম বর্ষ ১ম সেমিস্টার এর শিক্ষার্থীদের নিকট হতে ভর্তি রশিদের ছাপা ভুল করে কন্টিনিউয়াস এসেসমেন্ট, মিডটার্ম পরীক্ষার ফি আদায় করা হচ্ছে না। যেহেতু তা রাষ্ট্রীয় আদায়কর্তব্য অর্থ সেহেতু সর্বসম্মতিক্রমে ভর্তি রশিদ সংশোধন করা হয়।

সে সময় দায়িত্বশীল ছাত্র নেতৃত্বও বিষয়টি অনুধাবন করে। কিন্তু ছাত্র ফ্রন্ট নেত্রী হিসেবে জ্ঞাত সিরাজাম মনিরার নেতৃত্বে একদল ছাত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি বৃদ্ধি করার প্রচারণা করে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু কালাম মো. ফরিদ-উল ইসলামের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি একাডেমিক ভবনসমূহ অবরূদ্ধকারী শিক্ষার্থীদের ডেকে বিষয়টি খোলাসা করা হয়। ভবনসমূহ অবমুক্ত করার অনুরোধে তারা ১০ মিনিটের সময় নিয়ে বাইরে আসে।

কিন্তু আধাঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আমরা কিছু শিক্ষক আন্দোলনকারীদের একাডেমিক ভবনের সামনে হতে সরিয়ে দিয়ে তালা ভেঙ্গে গেট খুলে দিয়েছিলাম। এতে সিরাজুম মুনিরা তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিল, ‘সরকারের পা চাটা কুত্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়’।

স্ট্যাটাসের বিষয়টি শিক্ষক মহলে ব্যাপক হইচই ফেলে দিলে সেই শিক্ষক যে সিরাজাম মনিরাকে নিজের পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন তিনি মন্তব্য করলেন একজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে ব্যবহার করেছে তাতে সে যেকোনো কথাই লিখতে পারে।

তাকে বলেছিলাম আপনি এভাবে বলছেন কেন? নারী শিক্ষার্থী বিষয়টি সামনে টানছেন কেন? আর কী ব্যবহার করা হয়েছে? আমরা তো কেবল তালা খুলে দিয়েছি।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই বিতর্কিত শিক্ষার্থী যখন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেল, সংগত কারনেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই চাকরিপ্রার্থী বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ আপনাকে জানানো হয়েছিল: ১। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারের পাচাটা কুত্তা হিসেবে ধারণ করে; ২। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে গালিগালাজ মিশ্রিত মন্তব্য করে; ৩। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ ধারণা অপপ্রচার করে। তারপরও এমন ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন কেন?

তিনি দায়ভার এড়িয়েছিলেন এভাবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন অধ্যাপক ও একজন সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের তরুন শিক্ষক নেতার নিয়োগ বোর্ডের আগের সারারাত জেগে লবিংয়ের চাপে পড়ে নিয়োগটি দিয়েছেন। আমরা বলেছিলাম যত চাপই থাকুক না কেন- পূর্ব থেকেই সরকারের বিরুদ্ধাচারণকারী একজন ব্যক্তিকে আপনি নিয়োগ দিতে পারেন না।

এখান থেকেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের ভাঙ্গন। একটি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন, আরেকটি বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন। সবাই জানেন, গত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ দুই অংশে নির্বাচন করেছে, একাংশের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামীপন্থি শিক্ষকবৃন্দ, অপর অংশে ছিল বামপন্থী শিক্ষকদের নেতৃত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্বিতীয় অংশের সমর্থন কিনতেই বিতর্কিত এই শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তার ফলাফল খুবই ভয়ঙ্কর। যে শিক্ষকদের লবিংয়ে এই বিতর্কিত ব্যক্তি শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছিল তাদের সরব সমর্থনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন একের পর এক অন্যায় করে চলেছেন। এই অংশের সমর্থন আছে বলেই ভর্তি পরীক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে জালিয়াতি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন লিয়াজোঁ অফিস, ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর প্রশিক্ষণ এর নামে কোটি টাকা অপচয় করে চলেছেন। এই অংশটার নির্লজ্জ সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। এই অংশটারই নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের কাজ স্তব্ধ করে রেখেছে।

রাষ্ট্রীয় আইন অবমাননা করে ডিনশীপ, বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব, বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির কার্যাক্রম, নিয়োগ বোর্ডের কর্তৃত্ব আরও অনেক কিছু স্বহস্তে কুক্ষিগত করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই অংশেরই নির্লিপ্ততায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রমোশন আটকে রেখে সচিবালয়ের প্রমোশন সংবর্ধনা প্রমোদে মেতেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কাজেই বলা যেতেই পারে, এই বিতর্কিত শিক্ষকের নিয়োগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বড় খেসারত দিয়ে চলেছে।

কাজেই এই শিক্ষকের ফেসবুক স্ট্যাটাস ভুল নয় বরং সজ্ঞানে সংগঠিত একটি অপরাধ বলে আমি মনে করি।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, রসায়ন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়