ছয়দফা থেকে স্বাধীনতা
বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের ইতিহাস ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। এ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলার মাটিকে চিরতরে স্বাধীন করার বীজ বপন করা হয় ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবীর মধ্যে দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা দাবী বাঙালী জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের ভিত্তিস্তম্ভ স্বরূপ।
এটি ছিল রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দুরদর্শী একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ছয় দফা এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, এই কর্মসূচিকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৮ বছর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাঙালির সীমাহীন বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার সুচিন্তিত দলিল। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তেও দীর্ঘ ১৮ বছরে প্রদেশ বা কেন্দ্রে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারেনি। প্রশাসনে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না।
বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। কিন্তু প্রায় সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। নানা অযৌক্তিক অজুহাতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নেওয়া হতো না। এসব কিছুই ছিল ঐতিহাসিক সত্য, তাই পাকিস্তানি শাসকরা প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য আর ভয়ভীতি দেখিয়ে ছয় দফার আন্দোলন দমন করতে পারেনি।
পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল নিয়ে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দিন অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ৬ দফা উত্থাপন করেন।
পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এই দাবির প্রতি আয়োজক প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেননি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা উত্থাপন করেন। এ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ৬ দফা ঘোষণার আগে দলীয় ফোরামে তা আলোচিত হয়নি। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার শুরুতে ৬ দফা প্রস্তাব করা হলে সভাপতি তর্কবাগীশ তার কয়েকজন অনুসারীসহ সভা ত্যাগ করেন। পরে সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে ৬ দফা গৃহীত হয়। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ বলে, মূলধারা বা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল কেউই সেই সময় ৬ দফা পছন্দ করেনি। ভাসানী থেকে আইউব সবাই ছিলেন বিরোধী। ছাত্র ইউনিয়ন তখন রুশ ও চীনা পন্থিতে বিভক্ত। আইউবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সব ধরনের চীনা পন্থীরা। পিকিং পন্থীদের কাছে শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ান সি আইয়ের এজেন্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী।
এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচী” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফায় পাকিস্তানি শাসকের ভিত কেঁপে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ৬ দফা কর্মসূচি জনগণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী গণসংযোগে অংশ নেন। যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ কয়েকটি স্থানে ৬ দফার পক্ষে প্রচারকালে বঙ্গবন্ধু গ্রেফপ্তার হন।
পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল দীর্ঘ কারাবাস। ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্র্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ছয় দফার বাস্তবায়ন ছাড়া বাঙালির জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এই অকুতোভয় বীর দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘সরাসরি রাজপথে যদি আমাকে একা চলতে হয়, চলব। কেননা ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ ব্রিটিশ শাসন ও শোষকদের এদেশ থেকে তাড়াতে ঐক্যমত হয়েছিল, ঠিক তেমনি হয়ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ৬ দফাকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। এই ৬ দফার প্রতিটি দফা বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার এই ৬ দফা দ্রুত বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয়।
১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের এক জনসভায় ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জুন মাসব্যাপী ৬ দফা প্রচারে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল ব্যাভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তেজগাঁওয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আজাদ এনামেল অ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যান ৬ জন শ্রমিক।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারী নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হন। বহু জায়গায় বিরুব্ধ জনতা গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্দোলন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পরিচালিত ৬ দফা আন্দোলনই ছিল সে সময়ে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু।
এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র সমাজের ৫ দফা দাবি যুক্ত হয়ে ১১দফা দাবিতে পরিণত হয় এবং এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয় ১৯৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যূত্থান। ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালি জাতি বিপুল বিজয় লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়