প্রধানমন্ত্রীর কৃষিতে আর্থিক প্রণোদনা ও বাংলাদেশে ব্লু ওশেনের অমিয় সম্ভাবনা
করোনার সুকঠিন প্রভাবে সারা বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের কঠিন সিদ্ধান্তের কারণে অচিরেই খাদ্য সংকট প্রকটতর হয়ে উঠতে পারে । জাতিসংঘের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীদের মতে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপনার জন্য এখনি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ কঠিন খাদ্য সমস্যায় পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে দেশে এপল, স্যামসাং সহ বিশ্বের নামীদামী সব ব্রান্ড তাদের আউটলেট বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে বেকারত্বের এক ভয়ালরুপ তৈরি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
বেকারত্ব, বিশ্বমন্দা এখন ঘরের দোয়ারে দাঁড়িয়ে, দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে বহু উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের কোটি কোটি মানুষ । মন্দার কথাই যদি বলি তাহলে একটু তাকাতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন শেয়ার মার্কেটের দিকে, কত বিলিয়নিয়ার নিমিষেই তাদের পদবি হারাচ্ছে। করোনার প্রভাবে এক মাসে আমেরিকার শেয়ার মার্কেট ২৭.৯৫ শতাংশ, ইউকে ২৯.৭২, জার্মানি ৩৩.৩৭, ফ্রান্স ৩৩.৬৩, এবং ভারতের ১৭.৭৪ শতাংশ শেয়ার মার্কেট হ্রাস পেয়েছে (সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটার ১২ই মার্চ, ২০২০)।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট গত ২৬শে মার্চ থেকে অদ্যাবধি বন্ধ। ফলে বিনিয়োগকারীরা কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। বাৎসরিক লভ্যাংশ আমেরিকাতে ২৭ শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে এবং ইইউ-তে ৩৭, জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমেরিকাতে কমতে পারে ৬.১ শতাংশ এবং ইইউ ৬.৯ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাকের মতে দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্যে নেমে যেতে পারে। অতএব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কি হবে সেটা ভাবাও অনেক কঠিন। মুসলমান হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলবো যে, ” আল্লাহ সুবহানোতায়ালা উত্তম হেফাজত কারী” কিন্তু আমাদের দায়িত্বে থাকা বিষয় গুলো আমরা কিছুতেই এড়াতে পারবোনা।
করোনা সময়ে এবং করোনা উত্তর দীর্ঘস্থায়ী ভাবে মানুষকে ক্ষুধা এবং মন্দা থেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করা এবং নিজেদের একটি পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করা। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময় উপযোগী পবিত্র বিষয় যেটিকে নিয়ে আসতে হবে সবার সামনে। যদি আমরা মানুষকে বাঁচাতে চাই এবং সাথে সাথে একটি স্বনির্ভর জাতী হিসেবে নতুন যোগ্যতা প্রকাশ করতে চাই । অতএব একটি দক্ষ ব্যবস্থাপনা, কৌশলগত বিষয়গুলো খুবই সর্তকতার সাথে কিন্তু কার্যকরী ভাবে খুব গতিশীলতার সাথে চিন্তা এবং কর্ম পরিকল্পনাকে এক করে একটি অথবা বেশ কয়েকটি Work Force এর মাধ্যমে একটি খুব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মনিটরিং কমিটির অধীনে এখনি নেমে পড়তে হবে।
যে বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে রেখে কৌশলগত কার্যসম্পাদন করতে হবে তম্মধ্যেঃ
প্রধানমন্ত্রীর ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা এবং অনতিবিলম্বে আসা বাজেটের আরো ৯ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা কৃষির জন্য অভ্যুত্থান সৃষ্টির এক অপূর্ব সুযোগ, যদি তা সুচারুপে মনিটরিং করে এর প্রকৃত ফলাফল বের করে আনা যায়। প্রথমত এই টাকা প্রকৃত কৃষকের কাছে সঠিক ভাবে, সঠিক সময়ে পৌঁছানো, তারপর কৃষক সে টাকা উপযুক্ত ব্যবহার করছে কিনা এ বিষয়টিকে নিশ্চিত করা এবং সাথে সাথে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা ও তা কৃষকের হাতে তুলো দেওয়া । এক্ষেত্রে প্রযুক্তি, কৃষকের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব এবং ব্যাংক হিসাব খুব ভালভাবে পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে ।
বাস্তবায়নের কৌশল কিভাবে হবে
আমাদের দেশের কোথাও এক খণ্ড জমিও খালি থাকতে পারবেনা। বাড়ীর আঙ্গিনা থেকে শুরু করে, মাঠ ঘাট, কৃষি আবাদি, অনাবাদী,সরকারী খাসজমি, স্কুলের সামনের মাঠের চারপাশ, ঘরের ছাদ, পুকুরের পাড়, পুকুর বা দীঘির পানির উপরিভাগ এমনকি জেল খানায়, ক্যান্টনমেন্ট এর খালি অংশগুলিকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে যে সব ফল অথবা সবজি চাষ করা যায় তা এখনি শুরু করতে হবে। আরো একটি বড় পরিসরের জায়গা হচ্ছে বাড়ীর ছাদ এখানে লক্ষ লক্ষ একর জমির পরিমাণ জায়গা আছে যা আমরা খুব সহজে কাজে লাগাতে পারি। আজকে কেউ বসে থাকলে চলবে না। ক্ষমতাসীন, বিরোধীদল প্রত্যেককে হাতে হাত মিলাতে হবে এবং এই কাজে যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
কে, কোথায়, কিভাবে কাজ করছে এবং করবে তার অগ্রগতির সচিত্র প্রতিবেদন থাকতে হবে। প্রথম দু মাস প্রতিদিনের প্রতিবেদন এবং তার পর সাপ্তাহিক প্রতিবেদন মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পৌছাতে হবে। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ দেশের বড় বড় কৃষি উপকরণ উৎপাদক, বিক্রেতাকে নিয়ে একটি Work Force দক্ষতার সাথে Work Plan তৈরি করবে। Work Plan এবং Work Force গুলির বেশ কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। সাথে আমাদের সমস্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন- আর্মি, বিজিবি, পুলিশ, আনসার সবাই এই কাজের সার্বিক সহযোগিতা, এমনকি কোন কৃষি কাজে রোপণ করার প্রয়োজন হলে তাও যেন করে ফেলে।
খুব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মনিটরিং কমিটি এই প্রকল্পটিকে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে শাইখ সিরাজকে প্রধান করে তার বিবেচনায় ৭-৮ জনের এই কমিটি তৈরি করে দ্রুততার সাথে কাজ শুরু করে দিতে হবে। শাইখ সিরাজ এর নামটি এই কারণেই আনা হল যে, বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের সাথে রয়েছে তার অনন্য সম্পর্ক । প্রযুক্তিকে একেবারে প্রথম দিন থেকে ব্যবহার শুরু করতে হবে।এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে 4G Technology কৃষিতে প্রয়োগ করে কৃষির উৎপাদন খরচ অর্ধেক কমানো সম্ভব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এ বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান রাখেন এবং তিনি খুব সুদৃঢ় ভবে এটা ধারণ করছেন।
সার, বীজ, কীটনাশক এবং অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়গুলোর সম্পাদন
সার,বীজ, কীটনাশক এবং অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়গুলোর খুব সুচারুপে সম্পাদনের জন্য তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সাথে সাথে প্রতিটি পাইকারি, খুচরা বিক্রেতা এবং ডিলারকে কাজে লাগাতে হবে যেন তারাও একাজটিকে নিজের কাজ মনে করে প্রতিটি ব্যক্তিকে সহযোগিতা প্রদান করে। এখন থেকেই যদি আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারি তাহলে আমরা দু’তিন মাসের মধ্যেই দেখব এক ব্যাপক সম্ভাবনা। করোনা দীর্ঘ সময় ধরে থাকলেও ইনশাআল্লাহ মানুষ না খেয়ে মরবে না।আর করোনা মহামারী যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে যায় তাহলে এটাই বাংলাদেশের জন্য আরেকটি যুগান্তকারী সফলতা বয়ে আনবে।
কৃষকদের জন্য আরো বিশেষ কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করা
বাংলাদেশের জন্মের আগে ও পরে যে কৃষক নিজেদের সর্বোচ্চ উজার করে আমাদেরকে সব চাইতে প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সরবরাহ করছে তাদেরকে সম্মান করার এর চাইতে উপযুক্ত সময় আর হবে না। যে দেশের মাটিই হচ্ছে সোনা, সে দেশের কৃষক অবশই সম্মানিত হওয়া উচিত।একজন প্রকৃত অবদানকারী কৃষক সিআইপি মর্যাদা পাবেন। দশজন প্রকৃত অবদানকারী কৃষক ভিআইপি মর্যাদা পাবেন। অন্যান্য দেশ থেকে কৃষি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা করা। ১০০০ কৃষক যদি ১ লক্ষ টাকা করে পুরস্কার পায় তাদের উৎসাহে কৃষিতে ১ লক্ষ গর্বিত কৃষক তৈরি হবে যারা দেশের আমূল পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হতে পারে।
কৃষক ধোঁকা দিবেনা, বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না বরং এরাই হতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট প্রদান সহ, তাদের সন্তানদের জন্যও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। যারা কম খরচে, কম বিদ্যুৎ ব্যায়ে, সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সাথে সর্বাধিক ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হবে তাদের কে জাতীয় বীরের সম্মান, তাদের কর মওকুফ ও অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনাও দেওয়া। ৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা রাখা দরকার সেই কৃষকদেরকে পুরস্কৃত করার জন্য যারা এই প্রণোদনা পাওয়ার মাধ্যমে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করবে। সরকার যদি এই ঘোষণা দেন যে ১০০০ কৃষককে ১ লক্ষ টাকা করে পুরস্কার প্রদান করা হবে তদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ। তাহলে আমার মনে হয় অনেক ভাল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
এক্ষেত্রে অবশ্য কৃষকশ্রেণীকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। যেমন:
১। চাল,গম,তৈল ও অন্যান্য রবি শস্য উৎপাদনকারী কৃষক- ৪০০ জন;
২। ফল উৎপাদনকারী কৃষক-২০০;
৩। ফুল উৎপাদনকারী- ২০০;
৪। অন্য উৎপাদনকারীদের -২০০
এখানে আরো একটি বিষয়কে অবশ্যই নিয়ে আসা জরুরী মনে করছি যে Team Force এই উপদেষ্টা কমিটি কাজ করবে তাদের জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি থাকা খুবই প্রয়োজন।
বণ্টন এবং বাজারজাত করন ব্যবস্থাপনা
খুব উৎপাদন হলো, কৃষক কৃষাণির চোখে মুখে হাঁসি, কিন্তু সঠিক বণ্টন ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে অচিরেই সেই হাঁসি মিলিয়ে যায়। কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পায়না। অবিকৃত পণ্য পুড়িয়ে ফেলে, রাস্তায় ফেলে অথবা স্টোরেজের অভাবে খুব দ্রুত পচে যায়, এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য এবং কৃষকের হাতে তার শ্রম এবং পণ্যের প্রকৃত মূল্য তুলে দেওয়ার জন্য সরকারকে দৃঢ়ভাবে অনেক গুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
*মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্বকে কঠিন হস্তে দমন করা
*পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা
*যে কোন ধাপে চাঁদা বাজি, টেন্ডার বাজির বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স থাকতে হবে
*পর্যাপ্ত স্টোরেজের, গুদাম ঘরের ব্যবস্থা করা
*বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স, দেশের বাইরে খুব ভালভাবে মার্কেট তৈরির চেষ্টা করবে। করোনার কারণে আজ অনেক দেশে ভোগ্য পণ্যের দারুণ সংকট এবং এটাকে ভালভাবে আমাদের পক্ষে কাজে লাগাতে হবে।
*পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের এম্বেসেডরকে আমাদের দেশিও কৃষিজ পণ্য এবং তাদের গুণাবলী তুলে ধরার উদ্ব্যোগ নেয়ার সাথে সাথে নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
একদিকে যেমন পৃথিবীর বড় বড় দেশ ক্ষুধা এবং খাদ্য সামগ্রীর অভাবে ভুগবে অন্যদিকে বাংলাদেশ তা অপ্রতিদ্বন্দীতার সাথে মার্কেট সৃষ্টির জন্য সুযোগ গ্রহন করবে। কোটি কোটি ডলার রপ্তানি সম্ভব হবে উদ্বৃত খাদ্য সামগ্রী থেকে।ব্যাপক থেকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সু ব্যবস্থা তৈরি হবে। নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্পকারখানা করার এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হবে।
সর্তকতা:
একটি বিষয়কে অবশ্যই খুব গুরুত্বের সাথে নিতে হবে তা হলো লোকবল নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে যারা কর্মঠ, সৎ, নিষ্ঠাবান এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা সম্পন্ন । এখানে কোন একটি ধাপে যদি চোর ,ঘুষখোর মোনাফেক কিংবা দলীয় শক্তি খাটানোর মনমানসিকতা সম্পন্ন লোক ঢুকে পড়ে তাহলে অন্য ধাপ গুলো আগানো অন্যদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে এবং তা অসম্ভবও হয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে যে কোন দুর্নীতি ধরা পড়ার মাত্র সাথে সাথে তার শাস্তি এবং চাকুরী চ্যুতির মতো কঠিন সিদ্ধান্ত আনাও জরুরী।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি (ডিআইআইটি)