জিপিএ-৫ এর আকাঙ্ক্ষা মেধা বিকাশের অন্তরায়
শিক্ষা এমন এক আলো যার সংস্পর্শে বিকশিত হয় জীবন আলোকিত হয় সমাজ। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার এ অর্থ। বর্তমানে শিক্ষা মানে দিন-রাত পাঠ চোকানো আর পরীক্ষার খাতায় তা উগলে ফেলা। এ উগলে ফেলার মাঝেই নিহিত রয়েছে আসল প্রাপ্তি-তৃপ্তি। হ্যাঁ, আমি একবিংশ শতাব্দীর পড়াশোনা ও পরীক্ষা পদ্ধতির কথা বলছি যেখানে মেধার সর্বোৎকৃষ্ট মাপকাঠি জিপিএ-৫।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং তন্মেধ্যে মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থী অর্জন করে সোনার হরিণ জিপিএ-৫। বর্তমানে জিপিএ-৫ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখে মনে হয় পড়াশোনার একমাত্র লক্ষ্যই বোধহয় জিপিএ-৫ হাসিল করা।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী অভিভাবকরা যারা জিপিএ-৫ অর্জনে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকরাও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেনা। প্রশ্ন ফাঁঁস, নকল সরবরাহ এবং টাকার বিনিময়ে জিপিএ-৫ ক্রয় খুবই পরিচিত উদাহরণ। শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর হলেও এক্ষেত্রে কিছু অসাধু শিক্ষক জাতি ধ্বংসের কাজে নিজেদের লিপ্ত করতে একবারো ভাবে না ফলে শিক্ষকতার মতো মহান পেশা কলুষিত হচ্ছে।
কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন জিপিএ-৫ এর গুরুত্ব কতখানি? যারা বইয়ের খুঁটিনাটি সবকিছু বুঝে বুঝে পড়ে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে তারা অবশ্যই মেধাবী। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ অর্জনের জন্য পুরো বই না পড়ে সংক্ষিপ্ত সাজেশন অনুসরণ করে। আর এতে করে তাদের জানার পরিধি এবং মেধার বিকাশ প্রস্ফুটিত হতে পারেনা।
অনেকে মনে করেন জিপিএ-৫ না পেলে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যাবে না এবং ভবিষ্যতে উচ্চপদস্থ চাকরি করতে বেগ পেতে হবে কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিবছর দলে দলে শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ না পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা সেরা বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। চাকরির বাজারেও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবিরা মেধার জোরে নিজের শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ৩৬তম বিসিএসের অদম্য লড়াকু মজুমদারের কথা বলা যায় যিনি এসএসসিতে জিপিএ-২.৭৫ পেয়েও শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিপিএ-৫ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনে অভিশাপ বয়ে আনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে অনেক শিক্ষার্থীই মানসিক ব্যাধিতে ভোগে যা পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনের অন্তরায়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নক্ষত্র শিক্ষার্থী হতাশায় কাবু হয়ে ঝরে পড়ে।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী সমাজের কাছে নিজেকে জিপিএ-৫ এর মাপকাঠিতে মেধাবি প্রমাণ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অর্থাৎ জিপিএ-৫ এর সাগরে নিজেকে বিসর্জন দেয়। আত্মহত্যার এমন ভয়াবহ চিত্র কোমলমতি পিইসি পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিকের তরুণ-তরুণীদের মাঝেও দেখা যায়।
২০১৯ সালে পটুয়াখালিৎীর ফাহিম পিইসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেয়ে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে, একই বছরে বরিশালের সারিয়া আক্তার এবং বগুড়ার তামিমা ইসলাম এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেদের জলাঞ্জলি দেন।
এভাবেই জিপিএ-৫ এর অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে অজস্র সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। তাই জিপিএ-৫ এর বেড়াজাল থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে অভিভাবক, শিক্ষক এবং সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদেরকে যথাযথ জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জন্ম নিবে নিউটন, আইনস্টাইনের মতো বিশ্ববিখ্যাত প্রতিভাবান।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুবিপ্রবি)