এরপরও এরাই দেশ সেরা, এরাই মেধাবী!
বাংলাদেশে এতো এক্সপার্ট। টেলিভিশন খুললেই নানান বিষয়ের বিশেষজ্ঞ দেখতে পাই। আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে কতো শত বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি। কেউ রাজনীতির উপর মতামত দিচ্ছেন। কেউ অর্থনীতি কিংবা সমাজনীতির উপর মতামত উপস্থাপন করছেন।
কেউ ভূমিকম্প নিয়ে কথা বলছেন। কেউ মহামারী নিয়ে কথা বলছেন। এতো হাজারো বিশেষজ্ঞ আমাদের। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড যেমন আমাদের আছে। তেমনি নামি-দামী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিও আমাদের আছে। কি নেই আমাদের? আমরাই তো জগত সেরা!
আমাদের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রতিমুহূর্তে বলে বেড়ান- আমরাই সেরা! এইসব স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে পাশ করে বের হয়ে যারা বিসিএস ক্যাডার হয় কিংবা বড় বড় সরকারি চাকরি করেন; তারাও প্রতিনিয়ত বলে বেড়ান- আমরাই হচ্ছি প্রকৃত মেধাবী।
সবই মানলাম। আমাদের দেশে মেধাবী এবং সেরাদের আসলেই কোন অভাব নেই। তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে এই মুহূর্তে। গত দুই দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোরের নানান এলাকা থেকে অনেক মানুষ আমাকে মেসেজ করেছেন। ছবি পাঠিয়েছেন। ভিডিও পাঠিয়েছেন।
ওই সব ছবি এবং ভিডিওতে কেবল ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ভেঙে যাবার ছবি। এই এক জেলাতেই ২০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে দিন দুয়েক আগে হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়টির কারনে। এই ঘূর্ণিঝড়টি যশোর জেলার উপর দিয়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ কিলোমিটার বেগে বয়ে গিয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর কারো হাত নেই। এটি হতেই পারে। এর যেই বিধ্বংসী রুপ, সেটা থেকেও রক্ষা পাওয়া কঠিন। কিন্তু এরপরও তো মানুষ একটা প্রস্তুতি নিতে পারে। এতে করে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। এই যেমন আমাকে একজন মেসেজ করে লিখেছে
-স্যার, আমাদের যদি ১০ ঘণ্টা আগেও সতর্ক করা হতো, আমরা অনেকটুকু ফসল তুলে নিরাপদে রাখতে পারতাম। এছাড়া এই যে এতোগুলো মানুষ মারা গিয়েছে, এদের বেশিরভাগ মানুষ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে মারা গিয়েছে। কারন, এরা বুঝতেই পারেনি-এতোটা বেগে কোন ঝড় তাদের এলাকায় আঘত হানতে যাচ্ছে।
অথচ বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনের টকশোগুলোতে কাউকে দেখছি না এই নিয়ে কথা বলতে। আমার প্রশ্নটা আসলে অন্য জায়গায়। এই যে ঝড়টা যশোর, চুয়াডাঙ্গা এইসব জেলার উপর দিয়ে আঘাত হানতে যাচ্ছে, সেটা কি আমাদের আবহাওয়া অফিস জানত না?
আমি এই ঝড়টা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। কোন সতর্কবার্তায় বলা হয়নি এই ঝড় যশোর কিংবা ওই সমস্ত এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যাবে। এমনকি ছিল না কোন বিপদ সংকেতও। অথচ আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ, যার কিনা আবহাওয়া কিংবা ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই; সে পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ট্র্যাকিং দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল- কোলকাতার পর ঝড়টি যশোরে যাবে। তাছাড়া কোলকাতার পাশের শহরই তো যশোর। কোলকাতায় যখন ঝড় হচ্ছিলো- তখনও কি আমাদের আবহাওয়া অফিস বুঝতে পারেনি?
তাহলে কেন তারা কোন সতর্কবার্তা দিলো না? কেন তারা কোন বিপদ সংকেত দিলো না এই সব অঞ্চলের জন্য? ১৩৫ থেকে ১৪০ কিলোমিটার ঝড় মানে কি, সেটা কি তারা জানে না? বুঝে না? এতো প্রবল বেগে একটা ঘূর্ণিঝড় পাশের শহর কোলকাতা থেকে আমাদের যশোরের ঢুকছে; অথচ আমাদের আবহাওয়াবিদরা একটা সতর্কবার্তা পর্যন্ত দিতে পারেনি। যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে বেশ তীব্র গতিতে ঝড়টি বয়ে গিয়েছে। এমনকি ওই এলাকার জেলা প্রশাসকরাও কিছু জানত না!
কারন আবহাওয়া অফিস থেকে তো বলা হয়নি- ওই অঞ্চলের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাবে! তাছাড়া এই সব অঞ্চলে কখনোই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সেই অর্থে পৌছায় না। তাই ওই এলাকার কোন মানুষ এর জন্য প্রস্তুতও ছিল না। সাধারণ মানুষ প্রস্তুত নাই থাকতে পারে, কিন্তু আবহাওয়া অফিসের লোকজন কি করে- একটা সতর্কবার্তা না দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন?
আমি জানি, এই ঝড়টি হয়ত বাংলাদেশে খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এমনই একটা ঝড় সরাসরি বাংলাদেশের উপর দিয়ে চলে যায়; আর আমাদের আবহাওয়া অফিসের লোকজন ঠিক মতো সতর্কবার্তা দিতে না পারে- তাহলে এর ফল কি হবে সেটা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারা একটা ভুল করেছে। আমার মতে- এটি ভয়াবহ ভুল। অথচ এই নিয়ে কেউ কোন কথা বলছে না! এরাই আমাদের বিশেষজ্ঞ। এরাই দেশ সেরা মেধাবী। এই যুগে এসেও ঘূর্ণিঝড়ের সঠিক সতর্কবার্তা দিতে পারছে না। অন্য আরেক দল মেধাবী যারা নানান সব আলোচনা অনুষ্ঠানে যান। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন; এদের কেউ এই নিয়ে কোন আলোচনা-সমালোচনাও করছে না!
ভাবখানা এমন- সমস্যা নেই। খুব তো আর ক্ষতি হয়নি! যেই মানুষগুলো বেঘোরে মারা গেল। যেই ফসলগুলো হয়ত এক দিনের নোটিশে ঘরে তোলা যেত; সেই ক্ষয়ক্ষতির দায় কি কেউ নেবে না? অথচ বিশেষজ্ঞদের কাজ হচ্ছে- ভবিষ্যতে এমন হলে কি হতে পারে কিংবা কি হতে যাচ্ছে, এই নিয়ে মতামত দেয়া।
এরপরও এরাই দেশ সেরা! এরাই মেধাবী!