১৮ মে ২০২০, ১২:২০

দুই-চারটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাকীদের মানুষই মনে করে না

আমিনুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

আমি আমার অনেক লেখায় বলেছি- আমরা বাংলাদেশিরা ছোট বেলা থেকে'ই অন্য'কে ছোট করার অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়েই বড় হতে থাকি। জগতের অন্য আর কোনো কিছুতে আমরা আনন্দ পাই না! আমরা আনন্দ পাই অন্যকে ছোট করে।

আমি তখন ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। বিশ্ববিদ্যালয়টি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য বেশ বিখ্যাত। আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান পড়াই। সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে আলাদা কোনো সাবজেক্টে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ অনার্স-মাস্টার্স পড়ে না। যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশুনা করছে, তাদের সমাজ বিজ্ঞান নামে একটা বিষয় পড়তে হয় মাইনর সাবজেক্ট হিসেবে।

তো, এক সেমিস্টারে ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আমরা তিনজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছি। বাকী দুই জন'ই ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষক। একজন বুয়েট থেকে পড়ে এসেছে। আরেকজন আইআইটি থেকে পড়ে এসেছে।

এদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে- আপনি সমাজ বিজ্ঞান কেন পড়েছেন? সমাজ বিজ্ঞান পড়ে আসলে কি হয়? শুনে আমি ভাবলাম- ভদ্রলোক একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি কিনা প্রশ্ন করছেন- সমাজ বিজ্ঞানে পড়েছেন কেন! এটা পড়ার মানে কি! আমি তাকে এর কোনো উত্তর দেয়নি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে- এর কোনো দরকার নেই। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন। তাই তিনি সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করা এই আমাকে ছোট করে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছেন। অর্থাৎ কাজের ফাঁকেও তিনি অন্যকে ছোট করে আনন্দ নেবার চেষ্টা করছেন!

যেখানে আমেরিকার এমআইটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বলছে- মানবিক এবং সমাজ বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীদের বেশি করে পড়ানো উচিত। নইলে আপনি পড়াশুনা শেষ করে একটা ব্রিজ হয়ত বানাবেন। কিন্তু সেই ব্রিজটা বানাতে গিয়ে সমাজে কতো মানুষের উপর এর প্রভাব পড়বে, সেটাই তো আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না।

আজ এই বিষয়ে লেখার কারণ হচ্ছে- ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানান সব আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এই নিয়ে নানান আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে! এর মাঝে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আমি নিজেই শিক্ষকতা করেছি।

তো, এই যুগে এসেও আমরা পাবলিক-প্রাইভেট নিয়ে পড়ে আছি! ওই যে! বিষয়টা হচ্ছে অন্যকে ছোট করে আমরা আনন্দ পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানে, দেশের অন্য আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পড়াশুনাই হয় না! পড়াশুনা হয় কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আবার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখবেন ফার্মেসিতে পড়া ছাত্ররা আবার পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা গণিতে যারা পড়ছে; তাদের মূল্য দিতে চাইছে না! আর আপনি যদি মানবিক কিংবা সমাজ বিজ্ঞানে পড়ে থাকেন, তো কথাই নেই! এভাবেই চলছে!

আর আপনি ভাবছেন- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্ররা প্রাইভেটে পড়া ছাত্রদের ছোট করে বেড়ায়। সেটা ঠিকই আছে। আবার ধরুন আপনি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর মাঝে নামকরা দুই-চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। তো, আপনি আবার অন্যান্য ছোট প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের, মানুষই মনে করবেন না!

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করলে, আপনি আসলে এলিয়েন! কিংবা ধরুন কোন কারিগরি স্কুল থেকে পড়াশুনা করে এসছেন; তাহলেই সেরেছে! আর আমরা যারা সাধারণ স্কুলে পড়ে এসছি, আমাদের ধারণা-মাদ্রাসায় (আলিয়া) মনে হয় কোন পড়াশুনাই হয় না! ওখানে যারা পড়াশুনা করে, ওরা মনে হয়- আরবি ছাড়া আর কিছুই পড়ে না!

অথচ সেখানেও পদার্থ বিদ্যা-গণিত থেকে শুরু করে সব কিছুই পড়ানো হয়। সেখানকার ছেলে-পেলেরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিংবা বুয়েটেও চান্স পায়। কখনো কখনো ভালো রেজাল্ট করে বড় বড় জায়গায় চাকরিও করে। তাতেও রক্ষা নেই!

ধরেন আপনি ভালো একটা চাকরি কোনভাবে নিজ যোগ্যতায় (খুব কঠিন যদিও, ব্র্যান্ড না হলে আজকাল আর জোটে না। এরপরও ধরেন জুটিয়ে নিয়েছেন) এতেও শান্তি নেই। আপনি হয়ত পড়ে এসছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কিংবা কারিগরি স্কুল থেকে, অথবা মাদ্রাসা থেকে অথবা নাম না জানা কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে!

তো, আপনার সহকর্মীরা দিন-রাত আপনাকে সেটা মনে করিয়ে দেবে! পারলে আপনাকে ক্ষেত উপাধিও দিয়ে দিতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাই তো করছিলাম আমি দেশে। সেখানে তো আমার সহকর্মীরা সবাই শিক্ষকই ছিল। দেশের নামি-দামী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আমার শেষ রক্ষা হয়নি।

আমার সহকর্মীরা কোন না কোন বিষয় বের করে নিয়েছেন আমাকে ছোট করার জন্য। সমাজ বিজ্ঞানে কেন পড়লাম! মজা করার জন্য, আনন্দ করার জন্য আমাদের আসলে অন্য আর কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এখন এক দল আরেক দল সম্পর্কে লিখছে কিংবা বলে বেড়াচ্ছে। গিয়ে দেখেন- কি ভাষা তারা ব্যাবহার করছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তো মেধার চর্চা করার কথা। সমালোচনা করলেও সেটা গঠনমূলকভাবে করার কথা। অথচ দেখেন- এরা কিভাবে এক দল আরেক দলকে ছোট করে বেড়াচ্ছে!

এদেরও আসলে দোষ নেই। আমাদের শিক্ষকরাই আমাদের শেখায়- কিভাবে অন্যকে ছোট করে নিজেদের বড় ভাবতে হয়! ‘আমরাই সেরা’ এটাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষকদের কাছে পাওয়া প্রথম শিক্ষা! কারণ, ছোট বেলা থেকেই আমরা পরম মমতায় অন্যকে ছোট করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে বড় হতে থাকি। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)