ভেতরের পশুত্বকে ঢেকে মানবিক দিককে গুরুত্ব দিন
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টতে (এসডিজি) ১২ নম্বরে পরিমিত ভোগ এবং টেকসই উৎপাদন ধরনের কথা বলা আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই পরিমিত ভোগের বিষয়টি ভালভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে করোনার আক্রমণের ফলে। পরিমিত ভোগ করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীতে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় অথবা সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে কাজে লাগে।
সারাবিশ্বে প্রতিবছর ১.৩ বিলিয়ন টন খাবার অপচয় হয়, যা মোট খাবারের একতৃতীয়াংশ এবং বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। বাংলাদেশে মোট আহরিত খাবারের ৫.৫% প্রতিবছর নষ্ট হয় এবং শুধুমাত্র ঢাকাতেই ৫০০০ টন খাবার নষ্ট হয়। তবে এই লকডাউনের সময় এটা ধারনা করা অবিবেচনাপ্রসূত হবেনা যে, খাবার অপচয়ের পরিসংখ্যানটি উল্লেখজনকভাবে কমে গিয়েছে।
সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ ফুটপাতে আবার কেউ এসির নিচে সবাই মেকি রসালো, টসটসে, ঝাঝালো ফাস্টফুড খেতে জম্পেশ পছন্দ করে। কিন্তু লকডাউনের ফলে গত দুইমাস যাবত কেউ এই ফাস্টফুড খেতে পারছেনা। যার ফলে, একটা শ্রেণীর খাবারের জন্য বরাদ্দকৃত বিশাল একটা অংক বেঁচে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে আমার এক বন্ধুকে আমি পাঁচ নম্বর শিক্ষক বলে ডাকতাম। কারণ সে যে বাসায় টিউশনি করাত সেখানে এক মাধ্যমিকের ছাত্রের জন্য সে ছিল পাঁচ নম্বর শিক্ষক। অনেকেরই এই এক থেকে পাঁচ নম্বর শিক্ষক পর্যন্ত গত দুইমাসে খরচ কমে গিয়েছে, যার সর্বনিম্ন টাকার অংকে দাঁড়ায় ৫-৫০ হাজারের মত প্রায়।
অন্যদিকে, গত দুইমাসে লকডাউনের সময় শহরে জ্যাম ছিলনা তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় গাড়ির গ্যাস অথবা তৈল খরচে বরাদ্দকৃত অর্থ সর্বনিম্ন ব্যক্তিবিশেষ ১৫-৩০ হাজার বেঁচে গিয়েছে। একটা বিশেষ শ্রেণী আছে তারা বিভিন্ন ধরনের কম্পমান বিনোদনের জন্য একটা বিশেষ বরাদ্দ রাখেন, যদিও এই লকডাউনের সময় ৯০ ভাগের বেশি খরচ কমেছে এই খাতে।
প্রত্যেক বছর, ইফতার মাহফিলে খরচ করা হয় কোটি কোটি টাকা। ব্যক্তিবিশেষে সবারই এই ইফতার মাহফিলে একটা বরাদ্দ থাকে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যাবে এই ইফতার মাহফিলের খরচও কমে গিয়েছে ৯০ ভাগেরও বেশি। উপরের সবগুলো বরাদ্দকৃত খাত হিসেব করলে দেখা যাবে, এই দুই মাসের লকডাউনে ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষ খরচ কমেছে ২০ হাজার থেকে কয়েক লাখ এমনকি কোটি টাকা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সময়টা যেহেতু দুর্যোগের, নিজের ভিতরের পশুত্বকে ঢেকে রেখে কিছুদিনের জন্য মানবিক দিকেটিকে গুরুত্ব দিন।
দুইমাসের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়তি অর্থগুলো খরচ করার জন্য অন্য কোন খাত না খুঁজে এই দুঃসময়ে অভাবী মানুষদের মাঝে বিলিয়ে দিন। যে ছাত্রটি আপনার ছেলেকে অথবা মেয়েকে পড়িয়েছে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা তাদের দিয়ে দিতে পারেন আলোচনা সাপেক্ষে।
এই দুর্যোগে আপনার বরাদ্দকৃত টাকা থেকে বাকি বাড়তি টাকাগুলো বা খাদ্যসামগ্রী দান করতে পারেন পরিচিত অথবা অপরিচিত অসহায়, অভাবী মানুষদের মাঝে। যার ফলে, তারা করোনার করাল গ্রাসের সময় নিরাপদে থাকতে পারে। বাস্তবিক অর্থে, সরকারের পক্ষে এই আকস্মিক ভয়াবহ দুর্যোগ একা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। না খেয়ে থাকলে রুটি-রুজির জন্য মানুষ বাইরে যাবেই, তাদের সংখ্যাটাই বেশি। তারা নিয়মিত বাইরে গেলে সংক্রমণের হার যথানিয়মে বাড়তে থাকবে।
করোনার আক্রান্তের হার যথানিয়মে বাড়তে থাকলে প্রত্যেকটা খাত বিপর্যস্ত হবে। প্রত্যেকটা খাত বিপর্যস্ত হলে আপনার মুক্তি কোথায়? সম্মিলিত প্রয়াসই হতে পারে করোনা থেকে মুক্তির পথ। এর অংশ হিসেবে আপনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিগত বরাদ্দ দান করুন, নিজে বাঁচুন এবং অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করুন। ভিতরের পশুত্বটা কে ঢেকে মানবিক দিকেটিকে গুরুত্ব দিন।
লেখক: সহ-প্রধান গবেষক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি)