জীবন নাকি জীবিকা
আজ দেশের মানুষ একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। একদিকে জীবন অন্য দিকে জীবিকা। কোনটি তার প্রয়োজন? প্রশ্নটা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এর মত! নিম্ন শ্রেণীর জনগনের কাছে আগে জীবিকা, তারপর জীবন। কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণীর কাছে শুধুই জীবন, তারা জীবিকার জন্য বিশাল অর্থ ভান্ডার পূর্বেই গড়ে তুলে রেখেছে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতদিন সম্ভব সঞ্চয় ভেঙ্গে খাবে । কিন্তু করুণ পরিস্থিতি মোদ্দাকথা কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না।
সমাজের একটি শ্রেণী কখনোই কারো কাছে হাত পাতে না। তারা দিন আনবে দিন খাবে, কারো কাছে আত্মসম্মান বিলি করে দিবে না। উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই শ্রেণী। কিন্তু আজ তারা সবচেয়ে অসহায় । চারপাশে এত ত্রাণের ছড়াছড়ি থাকলেও ঐ শ্রেণীটা আজও কারো কাছে না পারছে হাত পাততে, না পারছে ঘরে বসে থাকতে। এদিকে এমন দীর্ঘকালীন লকডাউনের প্রভাবে ঐ শ্রেণীর সঞ্চয়ে ভালভাবেই আঘাত করেছে।
দীর্ঘদিন শপিংমলগুলো বন্ধ থাকাতে অনেক ক্ষুদ্র দোকানিও তার পুঁজি অনেকটা সাবাড় করে ফেলছে দিন দিন। ফুটপাতের পাশে বসা চটপটি-ফুসকা ওয়ালা, ফল বিক্রেতা, ভ্যানে করে নিয়ে কাপড় ব্যবসায়ী তথা হকারদের কথা নাই বললাম। এতকিছুর পরেও শপিংমলের মূল মালিক দোকানিদের কাছ থেকে ঠিকই ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে । নিরুপায় ব্যবসায়ী তার শপিংমল না পারছে ছেড়ে দিতে, না পারছে ব্যবসা করতে।
এদিকে সরকার সীমিত আকারে শপিংমল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিভিন্ন জেলা প্রশাসন, দোকান-মালিক সমিতি এসব বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও কি দোকানিরা এমন সব অদ্ভুত আইন মেনে চলবে? জীবন যেখানে জীবিকার অভাবে নিঃস্ব, জীবন বাঁচানোর জন্য লকডাউন সেখানে হাস্য।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও দীর্ঘদিন যাবত ঘরে বন্দি। শুধু খোলা আছে পণ্যবাহী যানবাহনগুলো। গার্মেন্টস শিল্প দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর তা খুলে দিলেও পরিবহন খুলে দেওয়া হয় নি। ফলে শতমাইল পথ গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাড়ি দিতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। তখন এসব গার্মেন্টস শ্রমিকদের চিন্তা কখনো জীবন নিয়ে ছিল না, ছিল তাদের জীবিকা নিয়ে। তাদের অনেকের মতে, “জীবন দিতে রাজি, তবে না খেয়ে নয়”।
এতসব কিছু বন্ধ থাকার পরও বন্ধ নেই বাসা ভাড়া দেওয়া । এখনো মাস শেষ হলে বাসার মালিকগণ তাদের বাসা ভাড়া নিতে চলে আসে ভাড়াটিয়াদের কাছে। কিন্তু লকডাউনে যার পেটই চলে না সে কি করে বাসা ভাড়া দিবে। বিধছে নতুন সমস্যা।
প্রায় আড়াই মাসের লকডাউনে টিউশনি করে সংসার চালানো ছেলেটার মাথায় ভূত তাড়া করে বাসা ভাড়া নিয়ে। যেখানে অভাবের তাড়নায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে প্রশাসন এখনো নির্বিকার বাসা ভাড়ার সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে।
এই পরিস্থিতিতে সব কিছু বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল মুদি দোকান, ওষুধের দোকান, কাঁচা বাজার সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানগুলো। সাথে পণ্যবাহী ট্রাকও। এমন পরিস্থিতিতে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেলেও অর্থ কামিয়ে নিয়েছে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা। ফলে ঐ যে এক শ্রেণী শুধু অর্থ ব্যয় করেছে জীবিকা নির্বাহ করতে, তার কাছে ছিল না কোন আয়ের পথ।সে শুধু ব্যয়ই করে গেল, আর আরেক পক্ষ শুধু শুধু সংগ্রহই করে গেল। করোনা পরবর্তী বিশ্বে দেখা যাবে অর্থ শুধু একটি শ্রেণীর হাতে পুঞ্জিভূত, আরেক শ্রেণী হয়ে উঠবে শোষিত। ফলশ্রুতিতে দাস সমাজ ব্যবস্থা ফিরে আসলেও কিছু করার থাকবে না।
বর্তমান পরিস্থিতি একটি বিষয়কে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছে। পরাশক্তি বা অর্থনীতি সমৃদ্ধতা কোন শক্তি না, যদি না থাকে ঐ দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজ যদি সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ও কৃষির দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখা যাবে তারা অর্থনীতিতে যতটা এগিয়ে, কৃষিতে ততটাই পিছিয়ে। তাদের খাদ্য সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। বর্তমানে যদি রপ্তানিকারক দেশগুলো তাদের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় কোন কারণে, তাহলে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
মূল কথায় আসি, এতকিছুর মধ্য দিয়ে জীবন কে পরিচালনা করলে জীবন দিন দিন আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।পুরো জাতিকে গুনতে হবে বড় মাশুল। তার চাইতে জীবনকে পরিচালনা করা উচিত ডারউইনের থিউরির মধ্য দিয়ে,”survival of the fittest”। জীবন যুদ্ধ যারা বিজয়ী তারা টিকে থাকবে, অন্যরা হারিয়ে যাবে। অনেকটা অমানবিক মনে হচ্ছে প্রস্তাবটি। কিন্তু ভবিষ্যত আরো বেশি অমানবিক হয়ে উঠতে পারে। যেখানে ব্যক্তির জীবিকা নেই, সেখানে জীবনও থাকতে পারে না। বরং জীবিকা থাকলে জীবন থাকার সম্ভাবনা অধিক। এই ভাইরাসে মৃত্যুর চাইতে বেঁচে যাওয়ার হারই অত্যধিক।
লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়