ব্যবসায়ী-শ্রমিকের লকডাউন ও বাস্তবতা
আনোয়ার হোসেন। বাসার নিচে ঠেলায় করে তরকারি বিক্রি করেন। আগে হোটেলে চাকরি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু করোনায় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে তরকারি বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে যান তরকারি কিনতে। সারাদিন বিক্রি করে যা থাকে তাই দিয়েই কিছুটা সংসার চলে। তবুও এপ্রিল মাসের বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি। বাড়িওয়ালা চলে যেতে বলায় উঠতে হয়েছে নতুন বাসায়। এ তো শুধু এক আনোয়ারের গল্প। এমন হাজারো গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারাদেশে। যাদের পরিবারের আয় ক্ষুদ্র ব্যবসা, গণপরিবহণ কিংবা গার্মেন্টস থেকে।
বাংলাদেশে করোনা ঝুঁকি এড়াতে গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে লকডাউন। এক মাস পর ২৬ এপ্রিল থেকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা খোলা হয়েছে। ১০ মে থেকে সীমিত পরিসরে দোকানপাটও খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণের বিশাল একটা ঝুঁকি থাকলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকদের থেমে যাওয়া অনিশ্চিত জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে। যেভাবে গত একমাস লকডাউন চলছিল এভাবে ৬ মাস চললেও করোনা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। হয়তো আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যেত। কিন্তু অপরপক্ষে এ লকডাউনে দিনমুজুর শ্রমিকশ্রেণী না খেয়েই মারা যাওয়ার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে। চারদিকে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। সরকার নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য ত্রাণ পাঠালেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি এ ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কিছু ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরাই বড় ‘বাধা’।
শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য মার্চ মাসের শেষের দিকে গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ প্রণোদনা আসলে শ্রমিকদের কতটুকু কাজে আসছে সেটাও দেখার বিষয়। গত ১২ এপ্রিল জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন (১২ এপ্রিল) পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার কারখানার মধ্যে মাত্র ৭৬১টি কারখানা শ্রমিকদেরকে মার্চ মাসের বেতন দিয়েছে। অনেক জায়গায় মার্চ মাসের আগে থেকেই বেতন বকেয়া পড়ে আছে। এছাড়া এ কঠিন সময়ের মধ্যেও লে-অফ এবং শ্রমিক ছাটাই চলছে অনবরত। এপ্রিল মাসজুড়েই বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ছিল চোখে পড়ার মতো।
এছাড়া পরিবহণ শ্রমিকদের ইউনিয়নের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ পরিবহণ শ্রমিক রয়েছেন। লকডাউনের কারণে গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় তাদেরও খুব কঠিন সময় চলছে। শুধু ধনীরা বাঁচলে হবে না, তাদেরও বাঁচতে হবে। পরিবারকে বাঁচাতে হবে।
রাজধানীতে যারা আছেন তাদের আয়ের অন্য উপায়ও বের করা কঠিন। বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে অনেক খরচই গ্রামের মানুষের চেয়ে তাদের বেশি গুনতে হয়।
লকডাউনের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। মধ্যবিত্ত এসব পরিবার বিভিন্ন শপিংমল কিংবা অন্যান্য ব্যবসার মাধ্যমে আয় উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। যারা শহরের দিকে থাকেন দোকান ও বাসা ভাড়া দিতে ইতিমধ্যেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। অনেকে আবার ব্যবসা পরিবর্তন করে নামছেন অন্য পেশায়। তাদেরই বা কি করার আছে? পরিবার তাদেরও আছে। স্বপ্নও আছে।
কিছু সরকাররি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জন্য করোনয় আক্রান্ত ও মৃত্যু হলে পরিবারকে অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অথচ এসব নিম্ন আয়ের মানুষরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করবে। অর্থ সহায়তা দূরে থাক চিকিৎসার নিশ্চয়তা কতটুকু আছে? অনেকেই দেখছি অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। চিকিৎসা না পেয়ে মারাও যাচ্ছেন।
দেশে যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে ঠিক সে সময় কারখানা খুলে দেয়া, দোকানপাট শপিংমল খুলে দেয়াটা সত্যিই মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু কিছুদিন পর যদি মানুষকে না খেয়ে মারা যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয় সেটা হবে আরও বড় বিপর্যয়। আমাদের দেশে দুই তিন মাস ঘরে বসে খেতে পারবে এমন কয়টি পরিবার আছে? ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে খাবার না পাওয়ার তীব্র হাহাকার দেখেছি। এ হাহাকার আরও বাড়বে। সরকারকে সে প্রস্তুতিও নিতে হবে। মানুষ খাবার না পেয়ে অপরাধপ্রবণতার দিকে হাটবে। ডাকাতির কথাও ইদানিং বেশ শুনা যাচ্ছে। একমাসের কঠোর লকডাউন মানাতে পারলে বিপর্যয় অনেকটা ঠেকানো যেত। কিন্তু সে সুযোগটা এখন আর সরকারের হাতে নেই। সরকারকে তাই বাধ্য হয়ে হার্ড ইমিউনিটির পথে হাটতে হচ্ছে।
লেখক:শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়