করোনা কি বদলে দেবে মানবসভ্যতা?
আর কি হবে না পহেলা বৈশাখে শাহবাগের মঙ্গল শোভা যাত্রা? আর কি দেখা যাবে না চট্টগ্রামের জব্বারের বলিখেলা? ফুটবল বিশ্বকাপে গ্যালারিতে আর কি দেখা যাবে না ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উচ্ছ্বাস? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষ গায়ে গায়ে ঘেষা ঘেষি করে রাজনীতির লড়াইয়ে আর কি সামিল হতে পারবে না?
করোনা কি তাহলে পাল্টে দেবে মানবসভ্যতার গতিপ্রকৃতি? পাল্টে যাবে মানুষের এতোদিনের অভ্যাস?
এরকম গভীর উদ্বেগের প্রশ্ন গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, ‘প্রতিশেধক তৈরির চেষ্টাতে কোন লাভ হবে না। অদুর ভবিষ্যতে করোনার কার্যকরী কোনও প্রতিশেধক তৈরি হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কারণ এই ভাইরাসটি যতটা ভাবা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর’।
ইতোমধ্যে গবেষণায় এটা স্পষ্ট যে, নিখুঁতভাবে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেকে সম্পুর্ন ভাবে পাল্টে ফেলার ক্ষমতা রাখে এই ভাইরাস।উহানে যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল তার চেয়ে অধিক শক্তিশালী ইউরোপের করোনা। ইউরোপের করোনার যে বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা আমেরিকার করোনা। আবার আমেরিকা-ইউরোপের করোনার বৈশিষ্ট্যের চেয়ে অনেকটা আলাদা দক্ষিণ এশিয়ার করোনার বৈশিষ্ট্যের।
খুব তারাতাড়ি জিনোটাইপ বদলে ফেলছে এই ভাইরাস। ফলে সায়েন্টিস্টরাও ধরতে পারছে না এর সঠিক জিনোটাইপ। যার কারণে প্রতিশেধক বাজারে আনার সমস্ত ধাপ পার হতে না হতেই এই ভাইরাস সমস্ত বৈশিষ্ট্য পাল্টে ফেলতে পারে। ফলশ্রুতিতে কাজ করবে না প্রতিশেধক। তাই বলাই যায় লড়াইটা তখন ভ্যাকসিন বনাম ভাইরাসের হবে না। লড়াইটা হবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বনাম ভাইরাসের। যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি, তার টিকে থাকার ক্ষমতাও বেশি হবে। ফলে আসবে খাদ্যাভাসে পরিবর্তন।যেসব সবজি বা খাবার দেখলে বাঙালি নাক ছিকাতো, টিকে থাকার লড়াইয়ে সেসব খাবারই হবে প্রতিদিনের মেনু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ দূত সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, ‘এটা ধরে নেওয়া ঠিক না যে খুব শীঘ্রই করোনার কার্যকরী কোন প্রতিশেধক তৈরি হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে নিরাপদ জীবনযাপন শিখতে হবে। সব ভাইরাসেরই যে নিরাপদ এবং কার্যকরী কোন প্রতিশেধক তৈরি হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন অনেক ভাইরাস আছে যাদের প্রতিশেধক তৈরি অত্যন্ত কঠিন কাজ’।
HIV AIDS এর ভ্যাকসিন ৪০ বছরেও আসে নি। এ রোগে প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সারা পৃথিবীতে। ডেঙ্গুরও তেমন কার্যকরী ভ্যাকসিন বাজারে নেই। সাধারণ রাইনো ভাইরাস, অ্যাডেনো ভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন থাকলেও বাজারে পাওয়া যায় না।
যদি কয়েকবছরেও করোনার ভ্যাকসিন না পাওয়া যায় তবে বাজারে আসতে পারে কিছু ওষুধ। সম্ভবত রেমডিসিভিক তেমনি এক ওষুধ। এ ধরণের ওষুধ রোগের তীব্রতা কিছুটা কমাতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ন নির্মুল করতে পারে না। হাইড্রোক্সি ক্লোরকুইনও তেমনি এক ওষুধ যা কোভিড ১৯ এ অসুস্থ রোগীর এপর কাজ করছে না।
অতীতের অভিজ্ঞতা বলে ১৮ মাসে মানুষ কোন রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারেনি। ওষুধ আবিষ্কার হলেও তা সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। যদি সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে লকডাউন প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে কেমন হবে সেই সমাজ?
আপাতত আমাদের এই ভাইরাসের বিপদের কথা মাথায় রেখেই জীবন যাপন বদলে ফেলতে হবে। করোনা আসলে চিকিৎসা পদ্ধতিতেই প্রশ্ন তুলে দিল। গবেষকদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। ভাইরাস আটকানোর প্রধান উপায় কী? প্রতিশেধক নাকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চিকিৎসা?
এই ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্যই সংগ্রহ করতে পারছে না সায়েন্টিস্টরা। সন্ধান পাওয়া যায়নি ভাইরাসটির জিনোটাইপের।অনবরত ভাইরাসের মিউটেশন জটিল করে তুলছে প্রতিশেধক তৈরির প্রক্রিয়া। আজ থেকে এক মাস আগে করেনা রোগীর যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, এখন তা সম্পুর্ন পাল্টে গেছে।
ফলে প্রতিশেধক বের হলেই যে তা নির্ভুল কাজ করবে অথবা আগামী ৩/৪ মাস পর করোনার সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। হয়তো ক্ষণিক বিরতিতে মিউটেশন হয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে আক্রমণ করতে পারে এই ভাইরাস। ভবিষ্যতে মানব সভ্যতাকে হয়তো এই ভাইরাসকে সাথে নিয়েই পথ চলতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আগামী বছরের ১ম দিকে হয়তো মিলতে পারে প্রতিশেধক। প্রতিশেধক আবিষ্কারের পর ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফলভাবে শেষ হলে বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে আসতে সময় লাগবে আরো ৮ থেকে ১০ মাস। যদি প্রতিশেধক আবিষ্কার হয় আগামী বছরের আগে তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
ততদিনে বদলে যাবে মানব সমাজ। শারীরিক দূরত্ব, মুখাবরণ পড়া, বারবার হাত ধোয়া, রোজ কাজ শেষে বাড়ি ফিরে কাপড় ধুয়ে দেওয়া, এসব অভ্যাস স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে। সামান্য সর্দি কাশি বা দেহের তাপমাত্রা অল্প বাড়ার মত ঘটনার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে।
ফলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা লালদিঘীর ময়দানে লাখো মানুষের জমায়েত, ঠাসা থিয়েটারে মুভি দেখা, গাদাগাদি করে বাস ট্রেনে যাতায়াত, এই বিষয়গুলো হয়তো জীবন থেকে বাদ দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট