বেঁচে থাকুক আমাদের স্বপ্নগুলো, বিদায় হোক ঘাতকের
পৃথিবীতে সব সময় দেখে আসছি, মানুষ অসুস্থ হলে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন দৌঁড়াইয়া আসতো সাহায্য সহযোগিতা করতে। হাসপাতালে নেয়া থেকে ভর্তি করানোসহ চিকিৎসার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেয়া হতো। এসব করা হয়েছে সানন্দে। আর এখন দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। মানুষ আরেক জনের অসুস্থতার খবর শুনলে দৌঁড়ে পালাচ্ছে। আশ্রয় না দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। কি কলিকাল আসলো! মানুষ ইহজনমে কি এমনটা কখনো ভেবেছিল?
মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বাঁচে। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচাতে সাহায্য করে। স্বপ্নহীন মানুষ জীবন্ত লাশের মতো। মানুষ নিজে স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে। কেউ আছে নিজের স্বপ্নের পাশাপাশি অন্যকেও স্বপ্ন দেখায়।
একটা পরিবার বেঁচে থাকে তার উপার্জনকারীর উপর ভর করে। পুরো পরিবারের স্বপ্ন কাঁদে নিয়ে সংগ্রাম করা মানুষেরা হচ্ছে আমাদের প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধারা। এক একজন প্রবাসী এক একটা স্বপ্ন, স্বপ্নের নির্মাতা এবং বাস্তবায়নকারী।
মানুষ কত ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। স্বপ্নবান মানুষেরা শুধু নিজে বাঁচে না। তারা একটি পরিবার একটি সমাজ সর্বোপরি একটা জাতিকে বাঁচায়। অথচ আজ করোনা শত শত স্বপ্নকে ঝরে ফেলে দিচ্ছে। একটি পরিবারকে অসহায় করছে। একটি সমাজের আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। একটা জাতির অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করছে।
মৃত্যু চিরন্তন সত্য। কোরআনের বাণী, "প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করবে"। এই মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবনের ইতি ঘটে। সবার জীবনেই স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রত্যাশা থাকে। সে মরে গেলে আত্মীয় স্বজনরা আসবে শেষবার থাকে দেখবে। তার জন্য দোয়া করবে। তার জানাজা পড়বে। তাকে দাফন কাফন করাবে।
কিন্তু আজকের করোনায় আক্রান্ত মৃতকে কি আমরা স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে পারি? করোনা শুধু একজন মানুষকে মারছে না। এক একটি স্বপ্নকে মারছে। এক একটি পরিবারকে মারছে। কত নামি দামি সম্মানী অভিজাত ব্যক্তিরা আজ নিরবে নিভৃতে হারিয়ে যাচ্ছেন। জানাজায় লোক নেই। মুখটাও কেউ দেখতে আসছে না। কি অসহায় আমরা!
কবিও তাই যথার্থ বলেছেন, "জম্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?" পৃথিবীতে জন্ম গ্রহন করলে মরতে হবে। পৃথিবীতে মৃত্যুই একমাত্র সত্য। বাকি সব মিথ্যা। সেটা স্বাভাবিক হোক আর অস্বাভাবিক হোক।
কি নিদারুণ সে মৃত্যু! কি ভয়াবহ সে মৃত্যু! কত করুন সে বিচ্ছেদ। এটা নিচক কোনো মৃত্যু নয়। এটা স্বপ্নভঙ্গ!এটা যন্ত্রণা! এটা হাহাকার! একজনের প্রত্যক্ষ মৃত্যুর সাথে আরো অনেকের পরোক্ষ মৃত্যু এটা।
আজ টিভির পর্দা খুললেই দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে লাশের সারি। পত্রিকার পাতায় পড়তে হচ্ছে এক একটি স্বপ্নভঙ্গের করুন কাহিনী। এক একটি পরিবারের অসহায়ত্বের গল্প। পরিবারের অভিভাবক মারা যাচ্ছে সাথে সাথে পুরো পরিবারের জীবন্ত মৃত্যু ঘটছে। পিতা মারা যাচ্ছে সন্তান ও স্ত্রীকে জীবন্ত লাশ করে। সন্তান মারা যাচ্ছে পিতা মাতার হৃদয়কে পাথর করে।
একজনের আয়ের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে কতগুলো স্বপ্ন। স্বপ্নগুলো আজ মরে যাচ্ছে। বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালি স্বজনদের কথা বলছি, যারা বাংলাদেশের রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবেও পরিচিত।
এখন পর্যন্ত বহির্বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি মারা গেছেন। এই এক হাজারের অনেকে পরিবার নিয়ে আছেন প্রবাসে আবার অনেকের পরিবার দেশে। মৃত্যু কি শুধুই নিচক এই এক হাজার সংখ্যাটাই। না, তা কখনো নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই এক হাজারের সাথে জড়িত কয়েক হাজার পরিবার। লাখ কিংবা কোটি মানুষ।
দেশের স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আদরের ছোট ভাইয়ের শত আবদারের বড় ভাই আজ নেই। পৃথিবীর সর্বোন্নত রাষ্ট্রের সর্বাধুনিক সিটিতে বাস করতেন। চাওয়া মাত্র সব আবদার মিটিয়ে দিতেন। বড় ভাইকে ঘিরে ছোট ভাইয়ের হৃদয়ে হাজারো স্বপ্ন বাসা বাধা ছিল। আজ সেটি ঝরা পাতার মত শুকিয়ে গেছে।
কেইবা জানতো এই বড় ভাইটি পরিবারের অজ্ঞাতসারে আরো অনেক ছোট ভাইয়ের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। পাশের বাড়ির খেটে খাওয়া দিন মজুরের ছেলে কিংবা মেয়ের লেখা পড়ার খরচ জোগাতো নিরবে নিভৃতে।
প্রতিবেশি বৃদ্ধ কৃষকের বিবাহযোগ্য মেয়ের খরচ দিয়েছে সবার আড়ালে আবডালে। বাঁচিয়ে রেখেছিল বৃদ্ধ কৃষক আর তার মেয়ের স্বপ্নকে।
শয্যাশায়ী পঙ্গু লোকটার মেধাবী সন্তানের পরিক্ষার ফি দিয়ে পরিক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে,মেডিকেলে ভর্তির টাকা দিয়ে নতুন পৃথিবীর স্বপ্নটাকে চিরযৌবনা করে দিয়েছিল।
আজ এসব স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যু হচ্ছে ।
কে জানতো নিউইয়র্কে বাস করা পিতা পরিবারের পাশাপাশি কত অসহায় নিস্ব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কত রোগীর চিকিৎসার খরচ যুগিয়েছিল। বাঁচিয়ে রেখেছিল মৃত্যু পদযাত্রী অনেক স্বপ্নকে। আজ সেই পিতার মৃত্যুতে সকল স্বপ্নেরও অপমৃত্যু হলো।
ইতালি, স্পেন, লন্ডন, সিংগাপুর কিংবা সৌদিআরবে করোনায় মরে যাওয়া কোন ব্যক্তিই মরেনি, মরেছে অনেকগুলো স্বপ্ন।
বারবার ব্যবসায় লোকসান করা বড় ভাইকে ছোট ভাই সান্ত্বনা দিয়ে আর বলবেনা,চিন্তা করো না, আমিতো আছি। টাকা দিব, আবার নতুন করে শুরু করবে। নতুন স্বপ্নের আশা দেখাবে না আর কেউ। করোনা আজ হাজারো স্বপ্নকে হারিয়ে দিয়েছে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে অসুস্থ পিতার আহাজারি আজ আকাশ-বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। মাসে মাসে চিকিৎসার টাকা আর কে পাঠাবে এই চিন্তায় সময় যাচ্ছে।
লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশ পাটিয়েছে। ছেলে দীর্ঘ সংগ্রাম করে বৈধতা পেয়েছে। নতুন কাজও পেয়েছে। পরিবারের আট দশ জন সদস্যের জীবনে নতুন স্বপ্ন ডানা মেলেছে সবে মাত্র। স্বপ্নগুলো পালক মেলিয়ে উড়তে শুরু করেছে। কিন্তু ঘাতক করোনা পুরো পরিবারের স্বপ্নগুলোকে নিমিষেই চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। কি হবে এই পরিবারের। এই অসহায়ত্ব বড় জটিল।
জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠানো বাবার আধপাকা ঘর নতুন আঙ্গিকে চকচকে বিল্ডিং করার রঙ্গিন স্বপ্ন আজ ধুলায় ধুসরিত।
বাবা মা সহ পরিবারকে ছাড়া বিদেশে থাকা ছেলের গ্রীণ কার্ড পাওয়ার পর বিদেশ যাবে বলে স্বপ্ন দেখা পরিবারটি আজ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। ছেলের করোনা পজিটিভের খবরে চিন্তায় অস্থির দেশের স্বপ্নগুলো।
সন্তানের সামনে বাবা কিংবা মা। স্বামীর সামনে স্ত্রীর, স্ত্রীর সামনে স্বামীর করুন মৃত্যু সমস্ত স্বপ্নকে কবর দিয়ে দিয়েছে। কেউ কারো সেবা করতে পারছে না। কারো দেখভাল করতে পারছে না। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়। এতো কিছুর পরও আমরা স্বপ্ন দেখি,নতুন জীবনের স্বপ্ন। আর স্বপ্ন দেখি বলেই দূর্যোগের এই কঠিন সময়েও প্রবাসীরা এপ্রিল মাসে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন।
কবি তাই সত্যিই বলেছেন, প্রতিবাদ প্রতিরোধে নামাই জীবন, লক্ষ্যে পৌঁছে তবে থামাই জীবন, স্বপ্নে বেচা কেনা করাই জীবন, দেয়ালে ঠেকলে পিঠ লড়াই জীবন, প্রতিদিন ঘরে ফিরে, অনেক হিসেব করে, ‘এ জীবন চাই না’, তা বলাই জীবন।
সবকিছুর পরও প্রবাসে ভালো থাকুক আমাদের দেশের স্বপ্নগুলো। বেঁচে থাকুক হাজারো স্বপ্ন পূরণের নায়কেরা। বিদায় হোক ঘাতকের।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, ইচ্ছেঘুড়ি ফাউন্ডেশন
ই-মেইল: hasandu1992@gmail.com