তাহলে কি মসজিদে করোনা আসবে না?
(এক) ইস্যুটা ধর্মীয় সংবেদনশীলতার। তাই মুখ খুলে কেউ কিছুই বলতে চাচ্ছে না। সেইসাথে মসজিদ নিয়ে ধর্মপ্রান মুসলমানদের আবেগের প্রতিও সম্মান রাখাটা জরুরী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগও আসার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাছাড়া, আমরা যারা সাধারন মানুষ। যারা সম্মানিত আলেম-ওলামা বা মুফতি নই। আমাদের ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেবারও কোন এখতিয়ার নাই। বিপদটা তাই চতুর্মুখী!
কিন্তু খোলা চোখেই আসন্ন বিপদের চিত্রটিকে পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। যারা এতদিন গার্মেন্টস কিংবা শপিংমল খোলার বিরোধিতা করেছে। তারাও আজকে মসজিদ খোলায় আলহামদুলিল্লাহ বলছে। তাহলে কি মসজিদে করোনা আসবে না?
(দুই) সরকার বলছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। না হলে তারা একযোগে সবকিছু খুলে দিলো কেন? একটু খেয়াল করে দেখুন। মার্কেট খোলার ঘোষনা এলেও বসুন্ধরা ও যমুনা শপিংমল বন্ধের ঘোষনা দিয়ে দিলো কর্তৃপক্ষ। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য মার্কেটও নাকি বন্ধের ঘোষনা দিবে বলে শোনা যাচ্ছে। খেয়াল করুন, বসুন্ধরা ও যমুনা শুধু দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপই নয়। বরং দেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকও। সরকার যতই মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ও আক্রান্তের সংখ্যা গোপন করুক না কেন। এই শীর্ষস্থানীয় মিডিয়ার কাছে কিন্তু প্রকৃত চিত্রটি আছে। তাই সর্বাগ্রে তারা তাদের নিজেদের মলের কর্মকর্তা-কমর্চারী এবং মালিক সমিতির জীবনের নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে। নয়তো এই মুহুর্তে সরকারী ফরমানকে সরাসরি নাকচ করার মত সাহস কে দেখাতে পারে? কারন সাহসটা কেবলই জীবনের।
(তিন) সরকারের কাছে পরিস্কার দুটা অপশন। না খেয়ে মরলে সবাই সরকারকে দুষবে। আর করোনায় মরলে ভাগ্যকে দুষবে। আর সরকারও তখন দোষ দিবে জনগণের অসতর্কতাকে। যেমনটা ইতিপূর্বে করেছে প্রবাসী, ডাক্তার, জানাজাকে! তাই জনগণ যেহেতু অস্থির। মুসুল্লিরা যেহেতু উদগ্রীব। তাই এবার ধর্মীয় অনুভূতির পাল্লা ভারীর বিচারে সরকার বুদ্ধি করেই মসজিদটাকে খুলে দিলো। যেমনটা গার্মেন্টস ও মার্কেটের বেলায় করেছে। হিসাব সহজ। সব খুলে দিলাম। যে বাঁচার বাঁচুক। আর যে মরার মরুক। করোনা যখন কন্ট্রোলের বাইরে, অযথা ঘরে বসিয়ে জনগণকে খাওয়াতে যাবো কোন দুঃখে!
(চার) দুঃখজনকভাবে সত্য যে, আমরা কিছু মুমিন মুসলিমদের মধ্যে প্রবল ধারণা যে, যারা প্রকৃত মুমিন তারা কখনও মসজিদে গিয়ে মহামারীতে আক্রান্ত হবে না। হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়কালে রোমানদের সাথে এক যুদ্ধের সময় ব্যাপক মহামারী দেখা দেয়। ঐ মহামারীতে ২৫,০০০ মুমিন মুসলিম মারা যায়। যাদের মধ্যে বহুসংখ্যক সাহাবা (রাঃ) ছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আবু উবায়দা আমর আল জার্রাহ (রাঃ)। তিনি ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবার মধ্যে একজন। আরও মারা যান মুয়ায ইবনে যাবাল (রাঃ) মত প্রখ্যাত সাহাবী। আর উনাদের মত সর্বোচ্চ তাকওয়াবান মুমিন সাহাবী যদি মহামারীতে আক্রান্ত হতে পারেন, তাহলে আমরা কেন সতর্ক হবো না? আর যেখানে খোদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশ আছে যে, ‘যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)
(পাঁচ) আশ্চর্য, সাহাবারা কি করেছেন মহামারীর সময়, আর আমরা কি করতে যাচ্ছি! ইসলাম বিজ্ঞানভিত্তিক অতি সহজ এক ধর্ম। মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনকিছুরই হিসাব নেই এখানে। কঠোরতার বদলে আল্লাহর দয়া, রহমত ও ক্ষমা প্রাধান্য পেয়েছে শত কোটি গুন বেশী পরিমানে। আল্লাহ সবই জানেন। সবই দেখছেন। যেহেতু এটা কেবলই ক্ষনস্থায়ী জীবনের এক কঠিন পরীক্ষা, তাই আল্লাহ আমাদের ধৈর্য, বিশ্বাস ও সতর্কতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আল্লাহ গাফুরুর রাহীম আমাদেরকে দৌড়ে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে বলেননি। বরং আল্লাহ বলেন, ‘আর নিজের জীবন ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ১৯৫)
কাজেই নিজের জীবন রক্ষা করা যেমন অপরিহার্য। তেমনই অন্য দশজনকে যেকোনো বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখাও আমাদের প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যাতে আমরা এটার প্রয়োগ করি। আর আল্লাহ দ্বীনকে অনেক সহজ করেছেন, আমরা যেন একে কঠিন না করি।
লেখক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ