কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শ্রমিকদের অধিকার?
আজ মহান মে দিবস, ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এই দিন। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে সেদিন শ্রমিকেরা জীবন দিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।
২০২০ সালে এমন এক সময় মে দিবস পালিত হচ্ছে, যখন শ্রমিকদের অবস্থা ভালো নেই। করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকটে পুরো বিশ্ব।যার ফলে বাংলাদেশের অবস্থাও করুন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাধ্য করা হচ্ছে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতে। একদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে অন্য দিকে করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরীচ্যুত করা হচ্ছে অনেক শ্রমিকদের।
এই মানবগ্রহ ধনসম্পদে অনেক উন্নত হলেও এর পেছনে যে মূল চালিকা শক্তি শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিক শ্রেণির ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি। শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যে গুটিকয়েক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বিশ্বের সিংহভাগ সম্পদ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম বন্ধ, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু অঙ্গীকার ঘোষণা ও বাস্তবের মধ্যে এখনো বিরাট ফারাক রয়ে গেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয় না শ্রম আইন। ফলে অবহেলিত শ্রমিক শ্রেণী। অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে নির্দিষ্ট কোন কর্ম ঘণ্টা নেই। অফিসে ঢোকার নির্দিষ্ট টাইম থাকলেও বের হওয়ার নির্দিষ্ট কোন টাইম নেই। এসব বিষয়ে মুখ খুলতে গেলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। ফলে মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ কিছু টা ভালো হলেও এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি রয়ে গেছে নিম্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও নতুন মজুরিকাঠামোয় তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া অপূর্ণই রয়ে গেছে। ফলে এই শিল্পে অস্থিরতা কাটেনি। করোনা ভাইরাসের ফলে এই সংকট গুলো আবারও বড় করে দেখা দিয়েছে। শিল্পমালিকদের মনে রাখা প্রয়োজন, শ্রমিকের কাছ থেকে বেশি কাজ আদায় করতে হলে উপযুক্ত মজুরি দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে তারা তাদের ব্যবসাকে বড় করে দেখে।
বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত । তাঁদের চাকরি ও বেতন-ভাতারও নিশ্চয়তা নেই।নেই নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের অবস্থাও উদ্বেগজনক। গতবছর কয়েক দফায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পের শ্রমিকেরা বকেয়া বেতন-ভাতা আদায় এবং নতুন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পালন করে। সরকারের আশ্বাসে সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। লোকসানের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নও ঠেকিয়ে রাখছে তারা। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের জানা উচিত যে লোকসানের জন্য শ্রমিকেরা দায়ী নন, দায়ী হলেন এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশে শ্রমিকেরা বেতন বৈষম্যের শিকার। দু-একটি খাত ছাড়া শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশও নাজুক। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙা শিল্প, ইমারত নির্মাণশিল্পে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে। আবার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বাড়তি সময় কাজ করিয়ে নিলেও ন্যায্য মজুরি দেয় না। চাকরি হারানোর ভয়ে এসব নিয়ে মুখ খুলতে চায় না অনেক শ্রমিক।
মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা পাবেন। মালিকদের উপলব্ধি করতে হবে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে শিল্পের মুনাফা আদায় বা অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে না। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। এটাই মে দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ