বাংলাদেশে করোনার চরিত্র ভিন্ন, অন্য দেশের টিকায় কাজ নাও হতে পারে
করোনাসৃষ্ট মহামারী আজ ভয়ংকর রূপ লাভ করেছে। বর্তমানে ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ করোনাভাইরাসের শিকার। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো, এ ভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয় না, দেখা দিলেও খুব স্বল্প মাত্রায়। যা অনেক সময় মানুষ অগ্রাহ্য করে।
পত্রিকায় এসেছে, ভারতের বিজ্ঞানীরা বলছেন— সেখানে শনাক্তকৃত ৮০ ভাগ কোভিড-১৯ রোগীর কোনো ধরনের উপসর্গ নেই। এ সংখ্যাটা বাংলাদেশে কতো; তা এখনো নির্ণয় হয়নি। বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপ বা আমেরিকার মতো হবে কি না কিংবা এটা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সেটা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে সীমিত আকারে সেরালজিকাল টেস্ট করা হচ্ছে রোগী শনাক্তকরণের জন্য। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে গণস্বাস্থ্য-আরএনএ বায়োটেক লিমিটেড ‘ডট ব্লট টেকনোলজি’ ব্যবহার করে ভাইরাসের সারফেস প্রোটিনকে টার্গেট করে ডায়াগনোস্টিক কিট তৈরির কাজ করছেন।
যেখানে রিয়েল টাইম পিসিআরে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে ডট ব্লট পদ্ধতিতে সময় লাগবে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট। কিন্তু এই কিটে ফলস পজিটিভ/নেগেটিভ রেজাল্ট আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ পদ্ধতিতে গ্রহণযোগ্য ফলাফল পেতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের অ্যান্টিবডির উপর নির্ভর করতে হয়। যা তৈরি হয় রোগীর মধ্যে উপসর্গ দেখার দেয়ার ৫ থেকে ১১ দিন পর।
উপরন্তু কোভিড-১৯ রোগটি প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি তৈরিতে অক্ষম বা কম তৈরি করে তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল ফলস নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়াও কোভিড-১৯ আক্রান্তের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা কোভিড-১৯-এর ভ্রাতৃপ্রতিম অন্যান্য করোনাভাইরাসে কতটুকু ননস্পেফিসিফিক রিঅ্যাকশন করবে; সে সম্বন্ধেও সুস্পষ্ট ধারণা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বাস্ততায় এই কিট কতটা কাজে আসবে তা উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বলা কঠিন। তবে এ পদ্ধতিটি যখন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে, তখন কী পরিমাণ জনসংখ্যার মধ্যে এটি সংক্রমিত হয়েছিল, তার পরিসংখ্যান জানার জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি।
পরবর্তী কোভিড-১৯ ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণের জন্য এ উপাত্তটি অত্যন্ত প্রয়োজন হবে। এই ভাইরাসটিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রচুর গবেষণা করতে হবে প্রতিনিয়ত। কারণ এটা একটা আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় সময়ে সময়ে এর মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন হতে থাকবে।
গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত উহান থেকে সৃষ্ট ভাইরাসটি এক হাজার ৪০২টি মিউটেশন হয়েছে। যার ফলে এই ভাইরাসের প্রোটিনের মধ্যে ৭২২টি পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের কোন কোন অংশ ভাইরাসটিকে আরও বেশি সংক্রামক এবং ক্ষতিকর করে তুলতে পারে। এত বেশিবার মিউটেশনের ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে আগাম মন্তব্য করা কঠিন।
সম্প্রতি পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, নোভেল করোনা ভাইরাসের তিনটি প্রধান ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে- এ, বি, সি। অ্যামিনো অ্যাসিডের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে তারা এই দাবি করেন। এ (ঘোড়ামুখো বাঁদুর) আর সি মূলত পূর্ব-এশিয়ার বাইরে, ইউরোপে আর আমেরিকাতে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, টাইপ বি পাওয়া যাচ্ছে পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোতে। প্রতিনিয়ত ভাইরাসে এই মিউটেশন হওয়ায় এর ভ্যাকসিন সব এলাকায় একইভাবে কাজ করবে কি না; তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশে ভাইরাসের কোন ধরনটি বিদ্যমান, তা না জানলে এবং সেই অনুযায়ী দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি না করা গেলে, ভবিষ্যতে হয়তো অন্য দেশে থেকে আমদানি করা ভ্যাকসিন কাজ নাও করতে পারে।
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন তৈরি করার মত প্রয়োজনীয় মেধা, যোগ্যতা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আছে। কিন্তু সমস্যা হলো— এ গবেষণা চালিয়ে নেওয়ার মত মানসম্পন্ন গবেষণাগার নেই বললেই চলে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি অণুজীববিজ্ঞানী, ভাইরোলজিস্ট, রোগতত্ত্ববিদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের গবেষকদের এই করোনা মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
রিসার্চ বিশেষত বায়োলজিক্যাল রিসার্চের উপর জোর দিয়েই করোনা পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের এখনই রূপরেখা তৈরি করতে হবে। গবেষণা খাতে দিতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রয়োজনীয় বরাদ্দ।
রিসার্চকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে তরুণদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরও সেভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মহামারী প্রতিরোধে তারা আরও কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: উপাচার্য, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: যুগান্তর