করোনায় মৃত্যু ছুঁয়ে এসে অন্য ১০ জনকে বাঁচাতে রাজি
এ বছর জানুয়ারি মাসে উড়ে গেলাম স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্ন ছিল বিদেশে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ার। ৫৫ শতাংশ স্কলারশিপ। আর ফিরে তাকাইনি। কে জানত, দু’মাসের মধ্যেই ফিরতে হবে? কলকাতায় পা রেখে মা আর ঠাম্মার সঙ্গে দেখা না করেই আমায় বেলেঘাটা আইডি-তে বন্দি হয়ে থাকতে হবে?
স্কটল্যান্ডে মার্চের গোড়ায় করোনাভাইরাস শব্দটা কানে এলেও চিনা ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কাউকে মাস্ক পড়তে দেখিনি তখন। মায়ের কাছেই সব খবর পাচ্ছিলাম দেশে কী হচ্ছে। ওখানে মাস্ক বা স্যানিটাইজার, কিছুই পাইনি। শেষে মায়ের তাড়ায় অনলাইনে মাস্ক কিনলাম। স্যানিটাইজারের দাম পড়েছিল হাজার টাকা! কিছু দিন যাওয়ার পর স্কটল্যান্ডেও শুনলাম লকডাউন হতে পারে, পরিস্থিতি ভাল নয়।
ওমা, ১৬ মার্চ রাতেই ঘোষণা হল পরের দিন থেকে লকডাউন। মা বলল, এখনই চলে আয়। সে দিন সন্ধেবেলা প্রচুর টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হল। মাঝরাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম হিথরোর পথে। শ’য়ে শ’য়ে লোক সে দিন হিথরো বিমানবন্দরে। মনে আছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লাস্ট বোর্ডিং ছিল আমার। লাস্ট! একটুর জন্য ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলাম। না হলে একা অসুস্থ হয়ে স্কটল্যান্ডে বিনা চিকিৎসায় শেষ হয়ে যেতাম। সে দিন থেকেই বোধহয় সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, শেষ হতে হতেও হব না আমি!
না, এ ভাবে কোথাও বলিনি। আসলে সব জায়গাতে বলা হচ্ছে করোনা পজিটিভ মানেই মৃত্যু নয়! একদম তাই। মৃত্যু নয় বলেই আমি বেঁচে আছি।
মুম্বই বিমানবন্দরে নেমেই মনে হল গায়ে জ্বর! ইমিগ্রেশনে জানালাম। ওরা ভেবেছিল এক বার আমায় মুম্বই হাসপাতালে ভর্তি করবে। পরে হোম কোয়রান্টিন লিখে আমায় ছেড়ে দেয়। অথচ ১৮ তারিখ কলকাতা বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং হয় আমার। দেখা যায় জ্বর নেই। আমি ওদের বলি, আমার জ্বর ছিল। ওরা স্ক্রিনিং-এ জ্বর না পাওয়ায় আমায় ছেড়ে দেয়। বলে বাড়ি গিয়ে বেলেঘাটায় চেক আপ করাতে। আমার শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। প্রচন্ড মাথাব্যথা। জ্বর বাড়তে থাকে। বাবাকে বলি, সোজা বেলেঘাটা নিয়ে যেতে। ওখানেই যাই। দেখি লম্বা লাইন হাসপাতালে। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর আমার টেস্ট হয়।
বাবাকে জানানো হল আমায় এখনই ভর্তি করা হচ্ছে। আইসোলেশন ওয়ার্ড। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে নোভেলকরোনা আমার হয়েছে কি না, জানি না তখনও। বলা হল, টেস্ট নেগেটিভ এলে আমায় ছেড়ে দেওয়া হবে। হাসপাতাল শব্দটা শুনলেই কেমন হত আমার! অথচ আসতে হল। বাবকে একটা কথাই বলেছিলাম শুধু, বাড়ির খাবার খাব। সে দিন তাই হল।
পরের দিন স্যাম্পেল নিয়ে গেল। মা বেশ কান্নাকাটি শুরু করেছে। টেস্ট নেগেটিভ হলেই বাড়ি। ২০ মার্চ রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ আচমকা এক জন নার্স ডেকে বললেন, ‘‘আপনি নীচে আসুন, ডাক্তারবাবু ডাকছেন।’’ এক রকম ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মোবাইল হাতে নীচে যেতেই ওঁরা আমায় একটা কাচের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আপনার রেজাল্ট পজিটিভ। আর এ ঘর থেকে বেরোবেন না।’’ জামাকাপড়, মোবাইলের চার্জার, কিছুই আনিনি। ওঁরা বললেন, সব পাঠিয়ে দেবেন।
মুহূর্তে সব অন্ধকার! মনে আছে সেদিন হাউ হাউ করে একটানা কেঁদেছিলাম। একদম একা আমি! কাচের ঘর থেকে আমার কান্নার আওয়াজ কোথাও পৌঁছবে না! এ কী জীবন? রাত ১টা নাগাদ বাবাকে জানালাম। বাবা শক্ত ছিল। বয়ফ্রেন্ডকেও বললাম। ও সে দিন নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। সারা রাত সে দিন জাগা। ঘুম পালিয়েছে করোনার ভয়ে! বাবা সাহস দিয়ে যাচ্ছে, বলছে, ঠিক হয়ে যাব আমি। এ দিকে বাবা আমার কন্ট্যাক্টে আসায় সে দিন হাবড়ার বাড়িতে না ফিরে আমাদের বাগানবাড়িতে ছিল।
ভোরের দিকে ঘুম এল। শরীর ক্লান্ত। মা পরের দিন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরে যায়, আমি করোনা আক্রান্ত! শুরু হয় অন্য এক লড়াই।
মিডিয়ায় বলা হয়, আমি স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে তিন দিন ঘুরে বেড়িয়েছি। রোগ ছড়িয়েছি! মা-র কাছে অজস্র ফোন আসতে থাকে। আর পাড়ার লোকজন পুলিশ নিয়ে ঘেরাও করে বলে, আমি নাকি লুকিয়ে আছি! তবে পুলিশ বাড়ি সার্চ করে ওদের আশ্বস্ত করে, আমি লুকিয়ে নেই!
আমার তখন জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। মাথায় যন্ত্রণা। কাশি। শ্বাসনালীর ভেতরে মনে হচ্ছে কেউ জোর করে পাথর চাপিয়ে রেখেছে। আমার কি নিঃশ্বাস বেরোবে না আর?
আমার ডাক্তার এলেন। বললেন, আমি ঠিক হয়ে যাব। বললেন, ‘‘একদম প্যানিক করবি না। ভাববিই না তোর করোনা হয়েছে। ভাবলেই বুকে চাপ পড়বে। হার্ট ব্লক হবে। বিপদ সেখানেই…।’’ একটু স্বাভাবিক হলাম আস্তে আস্তে। দেখলাম, অক্সফোর্ড ফেরত যে ছেলেটি করোনা আক্রান্ত হয়েছিল, তার বাবা, মা এসেছেন হাসপাতালে। কাচের ঘর দিয়ে এক-দু’জন লোক দেখতে পেলে মনে হয়, এই তো, এই পৃথিবীর সঙ্গেই যুক্ত এখনও আমি। বেঁচে আছি। শিরায় শিরায় রক্তের ঢেউ!
একদিন খুব খিদে পেয়েছিল। নার্সকে বললাম টাকা দিচ্ছি বাইরে থেকে কিছু এনে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে নাকচ। আমার টাকা কেউ ছোঁবে না। এত কান্না পেয়েছিল যে আমার ডাক্তারকে টেক্সট করলাম। ওমা, উনি এক ব্যাগ ভর্তি চকোলেট, বিস্কুট পাঠিয়ে দিলেন। উনি স্বয়ং ভগবান। সব বিষয়ে আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এই মারণ রোগের লড়াইয়ে।
সময় এগিয়েছে এ ভাবেই। মানিয়ে নিয়েছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করি। ওরা আমায় কিছু কাজ দেয়। শরীর একটু ঠিক হলেই অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শুরু করি। এত দিনে আমার বয়ফ্রেন্ডও সামলেছে। ও সারক্ষণ মোটিভেট করত আমায়। ভেবেছিলাম ল্যাপটপ আনিয়ে ছবি দেখব। কে নিয়ে আসবে? বাবা আর আমাদের গাড়ির চালক তো রাজারহাটের কোয়রান্টিনে। আমার উল্টো দিকেই ভর্তি ছিলেন এক ব্যাংককর্মী। কথা বলার জো নেই। এক দিন শরীর ভাল ছিল, হেডফোন চালিয়ে নেচেওছিলাম। উনি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে, যে ভাবে হোক নিজেকে এই করোনা থেকে ভুলিয়ে রাখতাম।
২৮ মার্চ প্রথম আমার করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসে। আমি জানতাম না। আমার মা মিডিয়া থেকে খবর পায়। সে দিন আমার ডাক্তার এসে বলেন, ‘‘এটা প্রথম টেস্ট। এখন কাউকে বলবি না কিছু।’’ আমি হেসে বলেছিলাম, মিডিয়া ইতিমধ্যে সব জেনে গিয়েছে। তবে এক দিন পরে আবার সব পরীক্ষা হয়। আমার গায়ে চেপে বসা সেই জ্বর এ বার সত্যিই পালায়। আবার টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ! শুনি, আমি বাড়ি যেতে পারি।
যে দিন বাড়ি ফিরি সে দিন পুলিশকর্মীরা আমার সঙ্গে। এলাকার কর্পোরেশনের কর্মীরা, আত্মীয়রা হাততালি দিয়ে আমায় স্বাগত জানিয়েছিল। কী যে ভাল লেগেছিল! বাড়ি ফিরেও সোজা নিজের ঘরে চলে যাই। মা ডিজপোজেবল প্লেটে খাবার দিত, খেতাম। ডাক্তার যা যা বলেছে তাই করেছি। শুনেছি, হিমাচল প্রদেশে যে ছেলেটি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছিল, সে ফিরেই ৪০ জন বন্ধু নিয়ে পার্টি করেছিল। আমার ডাক্তার বলেই দিয়েছেন, সব নিয়ম মানলে ০.১% চান্স করোনা ফিরে আসার। দেখছি, করোনা ফিরবে বলেও মানুষ প্যানিক করছে। এটা ঠিক নয়।
বাড়ি ফিরে ১৪ দিন পর বাড়ির অন্য ঘরে যাই। এর মধ্যে আর একটা ঘটনাও ঘটেছে, স্বাস্থ্য ভবন থেকে ফোন করে আমায় প্লাজমা থেরাপির কথা জানিয়েছে। আমি রাজি আমার শরীর থেকে প্লাজমা দিতে। এই ভাবে যদি ১০টা মানুষেরও প্রাণ বাঁচাতে পারি এর চেয়ে বেশি কিছু এই জীবনে আমার আর চাওয়ার থাকবে না। মৃত্যু ছুঁয়ে জীবন দিতে পারি… এই আশীর্বাদ ক’জন পায়?
সূত্র: আনন্দবাজার