২৭ এপ্রিল ২০২০, ১৯:৪৭

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস

মোন্নাফ হোসাইন নিরব  © সংগৃহীত

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই পাঁচটি হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে পঞ্চম স্থানে রয়েছে চিকিৎসা। কিন্তু আমরা যদি বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করি! তাহলে প্রথমেই চলে আসে চিকিৎসা। কেননা এই চিকিৎসার জন্যই গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোথাও মিলছে না মানুষের এই চাহিদা। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোন মেডিসিন। ডাক্তাররা শুধু পরিশ্রম নয় তাদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে এর পেছনে।

দিনরাত একাকার করে দিয়েছে তাদের গবেষণায়। এ যেন এক দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলার মুক্তি সেনারা স্বাধীন করেছিল এই দেশ। আর আজ এই দেশের মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা পালন করছে চিকিৎসকরা। যদিও এখন পর্যন্ত কোন চিকিৎসক এর সঠিক চিকিৎসা বের করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

যাই হোক মূল কথায় আসি, সাম্প্রতি অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইসলামবিদ্বেষীরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যদি কখনো এর চিকিৎসা আবিষ্কার হয় তাহলে সেটা হবে বিজ্ঞানের অর্জন। এমনকি তারা শ্লোগানও দিচ্ছে,
‘যদি বেঁচে যাও এবারের যাত্রায়,
মনে রেখো, বিজ্ঞান বাঁচিয়েছে কোন মন্দির,মসজিদ নয়’

তাদের কাছে আমার প্রশ্ন হল কোথায় থেকে শুরু হলো এই চিকিৎসা পদ্ধতি? বিজ্ঞান তো নমুনা ছাড়া কোন কিছু পরীক্ষা বা নতুন কিছু তৈরি করতে পারেনা? তাহলে বিজ্ঞান কোথায় পেল নমুনা? ইসলামের প্রথম মানব-মানবী হযরত আদম আ. ও হযরত হাওয়া আ. যখন পৃথিবীতে আসলেন এবং মানুষের বংশ বিস্তার শুরু হল তখন তো বিজ্ঞান ছিল না? তাহলে তখন কি তাদের কোন রোগ হতো না? আর আর যদি রোগ হত তাহলে তারা সুস্থ হতোই বা কিভাবে?

জগতের প্রথম মানুষরা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে খাদ্য সংগ্রহ ও রোগ-ব্যাধি মোকাবেলায় যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তা থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূত্রপাত। হজরত ইদ্রিস (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে চিকিৎসাশাস্ত্র একটি অবকাঠামোর রূপ পায়। ইতিহাসবিদ আল কিফতি তাঁর ‘তারিখুল হুকামাত’-এ লিখেছেন, ‘ইদ্রিস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। এ বিষয়ে তাঁর কাছে ওহি আসে।’

চিকিৎসাশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হচ্ছে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর ওপর নাজিলকৃত কোরআন চিকিৎসাশাস্ত্রের সবচেয়ে বড়গ্রন্থ। মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চার ধরণ ও ধারণের কথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে পবিত্র কোরআন। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পণ্ডিত ড. কার্ল অপিতজি তাঁর ‘Die Midizin Im Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট। ৩৫৫টি আয়াতে মানবদেহের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হয়েছে।

হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বুখারি শরিফে ‘তিব্বুন নববী’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের অধীনে হাদিস রয়েছে কয়েকটি করে। সব হাদিসই রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ কার্যাবলি সংবলিত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজ হাতে শিক্ষা দিয়েছেন সঙ্গীদের। বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন।’

ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ার জগতে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাসপাতাল ছিল অস্থায়ী। যুদ্ধের ময়দানে অসুস্থ বা জখম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য তাঁবু করে সেখানে তাদের রোগ নিরাময়ে ওষুধ ব্যবহার ও সেবা-যত্ন করতেন। সাহাবিদের দিয়ে অসুস্থদের সেবা করাতেন।

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর উদ্যোগে লেখা হয় চিকিৎসা বিষয়ে বিখ্যাত ‘মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া’। ইয়াজিদ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহিম লেখেন ‘কিতাবুল উসুল আত তিব্ব’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থটি। খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান সর্বপ্রথম বিপুল অর্থ ব্যয় করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূচনা সম্পর্কে অধ্যাপক কে আলী লেখেন— ‘আরবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয় আব্বাসীয় আমলে। রাজধানী বাগদাদসহ বড় বড় শহরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। সর্বপ্রথম আলাদা আলাদা ইউনিটে পুরুষ ও মহিলাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। যথাযথ চিকিৎসক কর্তৃক যাতে যথার্থ ওষুধ প্রয়োগ নিশ্চিত হয়, সে জন্যও চিকিৎসাবিষয়ক পরীক্ষক নিযুক্ত করা হয়।

নবম শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীরাই সভ্যতার প্রকৃত পতাকার বাহক ছিলেন। নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। এ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন আবু আলী আল হুসাইন ইবনে সিনা। ইসলামের অন্যতম এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী পুরো বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলে সুপরিচিত।

ইবনে সিনা ছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় অভাবনীয় অবদান রাখেন প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুসলিম মনীষী। তাঁদের মধ্যে হাসান ইবনে হাইসাম, আলবেরুনি (৯৭৩-১০৪৮), আলী ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), আবুল কাসেম জাহরাবি (মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ), জুহান্না বিন মাসওয়াই (চক্ষুশাস্ত্রের ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন), সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, কুস্তা বিন লুকা, জাবির ইবনে হাইয়ান, আলী আত তাবারি, আর-রাজি, ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮), আলী ইবনে আব্বাস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কানুন ফিত তিব’ আরবজগৎ থেকে আনীত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। পাঁচ খণ্ডে এবং ৮০০ পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই চিকিৎসা বিশ্বকোষে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যেক যেন একসঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন।

আলী আত তাবারি (৮৩৯-৯২০) ছিলেন মুসলিম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের গৃহচিকিৎসক। তিনি খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফেরদৌস উল হিকমা’ নামে একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রই নয়—দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে। এটি গ্রিক, ইরানি ও ভারতীয় শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আর-রাজি: মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আর-রাজি (৮৬২-৯২৫) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিদ। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কীয়। প্রায় প্রতিটি রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন।

মানুষের কিডনি ও গলব্লাডারে কেন পাথর হয়, সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন।লাশ কাটার বিষয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেন ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’। এটি লাতিন ও ইউরোপের সব ভাষায় অনুবাদ করা হয়। শুধু ইংরেজি ভাষায়ই চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় বইটি। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘আল হাবি’।

এতে সব ধরনের রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ে ২০টি খণ্ড আছে। আল হাবির নবম খণ্ড ইউরোপের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ষোলো শতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। বইটিতে তিনি প্রতিটি রোগ সম্পর্কে প্রথমে গ্রিক, সিরীয়, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।

আলী আল মাওসুলি: চক্ষু চিকিৎসায় মুসলমানদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আলী আল মাওসুলি চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টনও তাঁকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। তাঁর ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ চক্ষু চিকিৎসায় সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। চোখের ১৩০টি রোগ ও ১৪৩টি ওষুধের বর্ণনা রয়েছে এ বইয়ে। তিনিই প্রথম চোখের রোগের সঙ্গে পেট ও মস্তিষ্কের রোগের সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই গৌরবময় ইতিহাস আছে মুসলমানদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সবকিছু থেকে আধিপত্য কমতে থাকে। চুরি হয়ে যায় অনেক থিওরি। ১৩০০ শতকে মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সেনারা ৩০ বছর ধরে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে অসংখ্য গ্রন্থাগার ও পুস্তাকালয় বিনষ্ট হয়। আজ যদি মুসলমানদের আবিষ্কার, থিওরি ও লিখিত গ্রন্থাদি থাকত, তাহলে করোনা নামক এই মহামারীর মোকাবেলা করতে বিশ্বকে এতো বেগ পেতে হতো না। সম্ভব ছিল আশাতীত কিছু উদ্ভাবন। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ পেত অভূতপূর্ব আরশি।

তাই আসুন সম্মিলিত ভাবে আমরা আমাদের স্মৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি। একমাত্র তিনিই পারেন এই বিশ্ব মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়