২৬ এপ্রিল ২০২০, ১১:০৬

তারপরও সান্ত্বনা, আমার মা ‘করোনা অভিশাপ’ নিয়ে যাননি

তিতুমীর কলেজ শিক্ষক কামাল হায়দার ও তাঁর মা মাহমুদা খানম  © শিক্ষকের ফেসবুক

করোনাভাইরাস। মরণঘাতী এই রোগ একদিকে যেমন বিশ্বকে কাঁপাচ্ছে, তেমনি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের আবেগ-অনুভূতিও। কঠিন এই সঙ্কটকালে অন্য অনেকের মত মা হারিয়েছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষক কামাল হায়দার। যে মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, করোনা আক্রান্ত হলে সামাজিকভাবে মানুষ কতটা অসহায় পড়ে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য লেখাটি তুলে ধরা হলো-

আমার মা
সহজ, সরল মানুষ ছিলেন। স্বামী হারিয়েছিলেন প্রায় ১৯ বছর আগে। তিনি আমাদেরকে আগলে রেখেছিলেন, তার কোন কষ্ট কখনও বুঝতে দেননি আমাদের। পছন্দ করতেন গ্রামের বাড়িতে থাকতে। গত দু’মাস সেখানেই ছিলেন। আম্মার সাথে প্রতিদিন ফোনে কয়েকবার কথা হত। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি অসুস্থ হলেও আমাদের বলেননি। ভেবেছিলেন ভাল হয়ে যাবেন।

কিন্তু শরীর বেশি খারাপ হলে এ মাসের ৪ তারিখে আমার ছোট ভাই লকডাউনের ভেতরে তাকে ঢাকা নিয়ে আসে। এরপর থেকেই বাসায় তার ডক্টর ছেলে ও জামাই চিকিৎসা দিতে থাকে। কিন্তু শরীর ভালো না হওয়ায় আমি ও আমার ছোট ভাই তাকে নিয়ে ঢাকা শহরের কয়েকটি হসপিটালে যাই কিন্তু কোথাও নেয়নি। কারন তার করোনা ভাইরাস টেস্ট করা ছিলনা। কিন্তু কোথায় করব টেস্ট?

আমার গাড়িতে চোখের সামনেই আম্মাকে দেখছি কীভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। আমরা দুই ভাই অসহায়ের মত ছিলাম। পরে বাধ্য হয়েই করোনা টেস্টের উত্তরা রিজেন্ট হসপিটালে ভর্তি করি; যেখানে অনেক করোনা রোগী ছিল। আমরা একরাত একদিন করনার সাথে ছিলাম। ওই দিন ১১/০৪/২০২০ রাতেই IEDCR থেকে একজন আম্মার ব্লাড নেয়। রিপোর্ট পাই তার পরদিন; আম্মার করোনা নেগেটিভ। তখন আমি আনন্দে খুব জোরে কান্না করেছিলাম। ভাবছিলাম এখন আম্মার সুচিকিৎসা হবে। সেদিন রাতেই ইউনাইটেড হসপিটালে আম্মাকে ভর্তি করি। আম্মার শরীর খারাপ হওয়ায় তাকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়। চিকিৎসা ভালো চলছিল। আম্মার অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল কিন্তু একদিন পরে ১৪/৪/২০২০ সকালে ইউনাইটেড হসপিটাল থেকে ফোনে জানানো হয় তারা আম্মার করোনা টেস্ট আবার IEDCR থেকে করিয়েছে এবং রিপোর্ট পজিটিভ। তারা এ-ও বললেন রোগীকে তারা রাখতে পারবে না। ভাবতে পারেন তখন আমাদের মানসিক যন্ত্রণা। এখন কোথায় যাব আমার মাকে নিয়ে যাকে ভেন্টিলেশন দেয়া আছে?

পৃথিবীর কোনো দেশে কি এ ধরণের রোগীকে হসপিটাল থেকে বের করে দেয়ার এমন নিয়ম আছে? আম্মার যদি করোনা হয়েই থাকে তাহলে ইউনাইটেড হসপিটালের আইসিউ-তে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হবে এবং আইসিউ লকডাউন করতে হবে। তা কি তারা করেছিল? করেনি। তারা একদিনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৪৬৭ টাকা বিল করল। তারা খুব চাপ দিচ্ছিল বিলের টাকা পরিশোধ করে আম্মাকে নিয়ে যাই। আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। কী করবো আমরা বুঝতে পারছিলাম না। বিল পরিশোধ করি।

ইতিমধ্যে কুয়েত-মৈত্রী হসপিটালে আমার বড় ভাই যোগাযোগ করে এবং সেখানে আইসিউ-তে একটি ভেন্টিলেটসন মেশিন খালি পাওয়া যায়। যেখানে ভেন্টিলেশন মেশিনে থাকা একজন রোগীর অক্সিজেন সাপ্লাই খুবই জরুরি; সেখানে একটি এম্বুলেন্সে ছোট একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপর নির্ভর করে আমরা আম্মাকে নিয়ে চললাম কুয়েত-মৈত্রী হসপিটালে। সেখানে যাবার পর আরেক বিড়ম্বনা। একজন ভদ্র-মহিলা ভেতরে দাঁড়িয়ে আমার কথা শোনার পর বললেন- রোগী নিতে ওয়ার্ডবয় আসবে। এদিকে এম্বুলেন্সের অক্সিজেন শেষ পর্যায়ে। আমি পাগলের মতো চিৎকার থাকি কিন্তু কেউ কোথাও নেই।

অনেকক্ষন পরে ওয়ার্ড বয় আসে কিন্তু রোগী নেওয়ার স্ট্রেচার পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে এম্বুলেন্সের স্ট্রেচার নিচে নামিয়ে তাতে করে হসপিটালের আইসিউতে নেওয়া হয়।

এরপর আম্মাকে আর দেখতে পাইনি। ভেতরে কী চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, জানিনা। তবে আম্মার নাকি bed sore হয়েছিল। ৬ দিনে কীভাবে bed sore হয়?? কোন যত্নই তাহলে নেয়া হয়নি? চিকিৎসা কি দেয়া হয়েছে জানিনা। ২০ তারিখে IEDCR এ আম্মার আবার করোনা ভাইরাস টেস্ট করা হয় এবং রেজাল্ট ছিল নেগেটিভ। আমাদের প্রাণপ্রিয় মা ২৩/০৪/২০২০ তারিখ বিকাল ৪টা ৩৫ মিনিটে আমাদের ছেড়ে চলে যান।

তাও ভাগ্যবান মৃত্যুর সময় আমার মায়ের শরীরে করোনাভাইরাস ছিল না। আমরাও ভাগ্যবান আমার মা করোনাভাইরাস নিয়ে মারা যাননি। কেননা সমাজে কিছু মানুষরূপী অমানুষ বাস করে। এরা যখনই জানতে পেরেছে আম্মার করোনা পজিটিভ, তখন আমাদের দুই ভাইয়ের মনে হয়েছে- আমরা চিড়িয়াখানার কোন অদ্ভুত জীব। আপনারা কি সেই সময়ের মানসিক যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছেন?

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ।