২২ এপ্রিল ২০২০, ১৭:১৫

চিকিৎসায় পরনির্ভরশীলতা!

  © ফাইল ফটো

‘‘ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।’’

ডি এল রায়ের এ গান আমাদের দেশের গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি। এ গানটি আমরা শুধু শুনিইনা মননে অনুভবও করি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সবাই কি তা করে?

আজ বিশ্ব করোনার কবলে জর্জরিত। প্রতিটি দেশ তাদের নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কারণ করোনা রোগীর বিদেশে চিকিৎসা নেবার সুযোগ নেই। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যত উন্নত তারা একে তত ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।

এখন আসি আমাদের বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। আমাদের দেশে নন রেজিস্টার্ড প্রথম মেডিক্যাল স্থাপিত হয় ময়মনসিংহে। কিন্তু প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মেডিক্যাল কলেজের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় ঢাকার বকশি বাজারে। মাঝে চলে গেছে ৭৪ বছর।

কালের পরিক্রমায় আজ দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ সংখ্যা ৩৬টি, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ সংখ্যা ৬৯টি। এছাড়াও আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ আছে ৫টি। সরকারি বেসরকারি সব মিলিয়ে ১১১টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। প্রতিবছর এই কলেজগুলোতে প্রায় ১০,৫৫৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়।

১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১০,৫৫৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবার সুযোগ পাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজে। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলাফল হলো: ২৫০০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক।

আমাদের দেশে যে হারে জেলায় জেলায় সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সে হারে মেডিক্যাল কলেজ হচ্ছেনা।আমাদের যে কয়জন ডাক্তার আছেন অনেকেই আবার সুযোগ-সুবিধা কম বলে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা তাদের মেধার প্রমাণ দিচ্ছে। তারা কিন্তু জন্ম ভূমিতে থাকছেন না।

এবার আসি আমাদের দেশের কত জন লোক দেশে বিদেশে চিকিৎসা নেন। আমাদের দেশের অনেক মানুষ সাধারণত ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। এদের মধ্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মধ্যবিত্ত এমন কি নিম্নবিত্ত পর্যায়ের লোকেরাও বিদেশে চিকিৎসা নেন। আমাদের ভিআইপিরা বিদেশে চিকিৎসা নেন এটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নিম্নবিত্তের কথা বললাম তারা অনেকাংশেই সহায় সম্বল বিক্রি করে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশ যায়।

একটি জরিপে দেখা যায় শুধু মাত্র ভারতেই ২০১৫-১৬ সালে ১ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে গেছে।সেখানে হাসপাতালগুলোতে মোট রোগী ভর্তি ছিলো ৪ লাখ ৬০ হাজার। যার মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজারই বাংলাদেশি।২০১৬ সালের এক জরিপ বলছে ভারতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা।আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ১০-২০ লাখ লোক ভারত ভ্রমণে যায়। যার ২০% লোক যায় মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে।

বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার কারণ-

* আমাদের দেশে চিকিৎসায় সেবায় এখনো উন্নত প্রযুক্তি আসেনি যেমনটি আছে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা ইউরোপ আমেরিকায়।
* আমাদের ভিআইপিরা দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেনা। এটা আমাদের ডাক্তারদের নিরুৎসাহিত করে।
* দেশি ডাক্তার এবং চিকিৎসায় আস্থা নেই।
* দেশপ্রেম নিয়ে অনেক বড় ধরনের করা যেরে পারে।

আমাদের যা করতে হবে-

আমাদের উপর মহলের উচিৎ চিকিৎসা খাতে পরনির্ভরশীল না হয়ে স্বনির্ভর হওয়া। এক্ষেত্রে আমরা মালয়েশিয়া এবং কিউবাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। মালয়েশিয়ায় ডা. মাহাথির মুহাম্মদ এবং কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো যেভাবে চিকিৎসা খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে তা আমরা অনুসরণ করতে পারি। ভিআইপিদের দেশিয় চিকিৎসায় উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আইন করে বিদেশে চিকিৎসা সাময়িকভাবে স্থগিত করা যেতে পারে।

আজ একটি দৈনিকে পড়লাম করোনাভাইরাস একটি সাম্যবাদী ভাইরাস। এটা ধনী-গরিব সকলকেই ধরে। কাউকে ছাড় দেয়না। এটা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসা সেবাও সাম্যবাদী হওয়া উচিত। চিকিৎসা খাতে ভিআইপি বলে কোনো ব্যবস্থা থাকা উচিৎ নয়।

এরই মধ্যে ঘোষণা শুনলাম দেশে নাকি ভিআইপিদের জন্য বিশেষ করোনা হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এটা দুঃখজনক ব্যাপার। আর যদি সত্যি তাই হয় তবে তা আমাদের চিকিৎসা খাতকে আরও যোজন যোজন দূরে নিয়ে যাবে। এবং তা হবে আমাদের সংবিধানের বিরোধী। চারটি মূল আদর্শের পরিপন্থী। আশাকরি এমনটি হবেনা।

পরিশেষে বলি আমাদের শপথ হোক এই দেশেতেই জন্ম আমার এই দেশেতেই যেনো মরি এই দেশেতেই যেনো নিজের চিকিৎসা করি।

লেখক: বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়