প্লেগ রোগের লকডাউনে আবিষ্কার হয় নিউটনের গবেষণা
ঘরে মন বসছে না? লকডাউন এ বিরক্ত? সামান্য একটা আণুবীক্ষণিক কীটের ভয়ে আপনি ঘরবন্দি দিনের পর দিন। কবে যে বেরোতে পারবেন তার কোনো ঠিক নেই। চেনা লোকগুলোকে দেখলেই আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে।
এখুনি ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে কক্সবাজার, জাফলং, কুয়াকাটা কিংবা পুর্বাচলের খোলা হাওয়ায় লাফাতে ইচ্ছে করছে। মুক্ত হবার আনন্দে। কিন্তু সে যে হবার নেই।
প্রিয় গানগুলো শুনতে শুনতে মনে তিক্ততা চলে এসেছে। ফেসবুক ঘেঁটে ঘেঁটে আঙুলে কালো দাগ পড়ে গেছে। আর কমেন্ট করার মতো কোনো বিষয় নেই। লাইক করার মতো মুখও নেই। যত রকম রান্নার পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায়, সাত মন তেল পুড়িয়ে আর হাতে গরম ছ্যাকা খেয়ে রান্নাঘরে ঢোকাটাই বন্ধ হয়েছে। ফেসবুকের যত ট্রেন্ড ছিল সব যেন করা শেষ।এখন ঘরে বসাতেই তিক্ততা এসেছে। একেই বলে হাউস আ রেস্ট।
লকডাউন জীবনে এনেছে বিস্বাদ। ভেঙে পড়বেন না। প্রলয়ের মাঝেই থাকে সৃষ্টির বাতায়ন। নিজেকে কখনোই হারিয়ে ফেলবেন না অবসাদের অন্ধকারে। একটু অতীতে যাওয়া যাক।
সালটা ১৬৬৫। লন্ডন শহরে হটাৎ করেই শুরু হলো প্লেগের দৌরাত্ম্য। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন কয়েক শ’ মানুষ এবং মৃত্যু অনিবার্য। সেদিন প্রথম তৈরী হলো ইংরেজি শব্দ সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং। এই সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের কথা মাথায় রেখে আর প্লেগের ভয়ে বন্ধ হলো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি খবরের কাগজের অফিসও।
ট্রিনিটি কলেজে তখন ছাত্র হিসেবে ছিলেন এক অগোছালো যুবক। নিজের খেয়াল খুশি মতো ঘুরে বেড়াতো। শিক্ষকরাও খুব একটা পাত্তা দেন না ওই ছাত্রকে। শোনা যায়, তার মা চেয়েছিলেন তাকে কৃষক হিসেবে মাঠে কাজ করাতে। সেখান থেকে সে এসে ভর্তি হয়েছে ট্রিনিটি কলেজে। গ্রিক, ল্যাটিনের ক্লাস করেন। কোনো ক্লাসে মনোযোগ নেই। শুধু অংকের ক্লাস এ বেশ মনযোগ দিয়েই শোনেন শিক্ষকদের কথা।
প্লেগের প্রাদুর্ভাবে রাতারাতি বন্ধ হলো কলেজ। ছাত্রদের বলা হলো দ্রুত বাড়িতে চলে যেতে। এবং কোনোভাবেই যেন বাড়ি থেকে না বেরোয় তারা। সেই খামখেয়ালি ছেলেটাও ফিরে গেলো নিজের বাড়িতে। কেমব্রিজ থেকে ৬০ মাইল দূরে উল্সথর্পে। আজকের মতো সেদিনও যানবাহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ঢাকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতোই পায়ে হেটে ৬০ মাইল দূরের বাড়িতে পৌঁছেছিলেন তিনি।
এসেই ঘরবন্দি। একে তো শহর থেকে ফিরেছেন। তার মধ্যে এতটা পথ পায়ে হেটে। ফলে বাড়ির লোকজন তার ধারেকাছেও আসতো না। ওই একলা ঘরটিই তখন তার দেশ। আর এমনিই তো তার একলা থাকার অভ্যাস ছিল। ছেলেটা একেবারেই কোনো বেরোনোর চেষ্টা করতো না ঘর থেকে। হয়তো জীবাণুর ভয়ে আর কিছুটা নিজের কাজের সময় নষ্ট হবে ভেবে।
ওর হাতে তখন ইন্টারনেট বা টিভি ছিল না। রান্না করারও ঝোক ছিল না। বসে বসে আপন খেয়ালে কষতো অঙ্ক। আর হাতের কাছে ছিল কিছু কাচের প্রিজম। জানালার একটা অংশ ছিল ভাঙা। সেখান দিয়ে ঘরে আসতো রোদের ছটা। ওই প্রিজমগুলো নিয়েই ওই রোদের সঙ্গে চলতো তার খেলাঘর বাধার খেলা।
যখন বিরক্ত ধরে যেত, তখন মাঝে মাঝে দেখে নিতেন বাইরে কোনো লোকজন আছে কিনা। লোকজন না থাকলে এসে বসতেন বাড়ির বাগানে। আপেল গাছের তলায়। একদিন সেই গাছ থেকে একটা আপেল পড়তে দেখেই ঢুকে গেলেন ঘরে।
এরপর ২ বছর পর প্লাগের প্রাদুর্ভাব কমে গেলো। ছেলেটা ধীরে সুস্থে আবার ফিরে গেলো ট্রিনিটি কলেজে।
তখন ১৬৬৭ সাল। ৬ মাসের মধ্যে প্রকাশ করলেন লকডাউনে থাকার সময় তার গবেষণা। ২ বছরের মধ্যেই হয়ে গেলেন ট্রিনিটির ফেলো। তারপর বাকিটা ইতিহাস।
ধরতে পারছেন ছেলেটা কে হতে পারে? ছেলেটার নাম স্যার আইজ্যাক নিউটন।
প্লেগে যখন মহামারীর আকার নিয়েছিল লন্ডনে, তখন ঘরবন্দি অবস্থায় তিনি যে অংক করতেন সেখান থেকেই আবিষ্কার আজকের ক্যালকুলাস।
জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি আর প্রিজম নিয়ে যে খেলা করতেন, সেটাই জন্ম দিয়েছিলো আজকের অপটিক্সের কঠিন কঠিন থিওরির। আর বাইরের বাগানের আপেল গাছের তলায় বসে একটু জিরিয়ে নেবার ফাঁকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল অভিকর্ষ থেকে মাধ্যাকর্ষণের কঠিন সূত্রের।
এ সবই হয়েছিল লকডাউনের সময়েই। অতএব যারা লকডাউনে ঘরবন্দি হয়ে বিরক্ত হচ্ছেন, তাদের কাছে অনুপ্রেরণা হতেই পারেন স্যার আইজ্যাক নিউটন।
লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট