১৮ এপ্রিল ২০২০, ১৬:০৯

ড. শামসুজ্জোহা বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী

মো. গোলাম মোস্তফা  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সৈয়দ মহম্মদ শামসুজ্জোহা। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য যে প্রেক্ষাপট সৃষ্টির প্রয়োজন পড়েছিল ড. শামসুজ্জোহা সেই প্রেক্ষাপটকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এদেশের মানুষ দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে প্রাণ দিতে পারে তা মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী ড. জোহার আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। মূলত তার আত্মত্যাগ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাইতো নয় মাসেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল।

সাদা প্রফুল্ল, মিশুক ও মহান হৃদয়ের অধিকারী ড. জোহা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৬১ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল, সেই সময়ে ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ওই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেইসাথে এদেশের মানুষের সাথে পাকিস্তানীদের অন্যায় অবিচারের চিত্র প্রকাশ হতে থাকে। ফলে তুমুল ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনকে বেগবান করতে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণ করে।

১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা সকাল বেলা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি নিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে গেলে পাকিস্তান সরকারের সৈনিকরা সেসময় শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে বাধা দেয়। তাদের উপর হামলা করে। ড. জোহা সেসময় শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদ করেন এবং শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, “শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।” নিষ্ঠুর সৈন্যরা ড. জোহার কথাকে অগ্রাহ্য করে গুলি করা শুরু করে।

তখন সকাল এগারোটা। ঠিক সেই সময় ড. জোহাকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য, প্রতিবাদ করার জন্য, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সৈন্যদের হাতে গুলি ও বেয়নেট বিদ্ধ হতে হয়। বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ড. জোহাকে মিউনিসিপ্যাল অফিসে একটা টেবিলের উপরে ফেলে রাখা হয়। বিকেল চারটার দিকে তাঁকে হাসপাতালের সার্জিকাল রুমে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কতোটা নির্দয়ভাবে মহান এই শিক্ষককে মারা হয়েছে ভাবা যায়!

প্রতিবছর ১৮ই ফেব্রুয়ারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শহীদ শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সরকারের উর্ধ্বতন কমকর্তা, জাতীয় বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। আক্ষেপের বিষয় আজ ৫০ বছর হয়ে গেলো। এতোদিন ধরে সরকারের কাছে ১৮ই ফেব্রুয়ারীকে জাতীয়ভাবে ড. জোহা দিবস ও জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবী জানানো হচ্ছে। কিন্তু তা কার্যকর ও বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। জাতি হিসেবে আমরা যদি এই মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই, তাহলে তা আমাদের জন্য হবে চরম লজ্জার একটি ব্যাপার।

ড. জোহা কেমন মহান মানুষ ছিলেন তা এই ছোট্ট লেখায় পাঠকে বোঝানে দুঃসাধ্য। মূলত তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন লালনকারী একজন অগ্রগামী বুদ্ধিজীবী। তার এই আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য এদেশের ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি অমর হয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়