করোনা মহামারিকালে বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশা
- মোঃ হাসান তারেক
- প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২০, ০৪:৫০ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৪৮ AM
নোভেল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেখা দেয়া মানবিক দুর্যোগের কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাড়িঁয়েছে বিশ্ব। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, বিশ্ব একটা মন্দার মধ্যে চলে গেছে। বহু গতানুগতিক অর্থনীতি যেমন পিছিয়ে পড়েছে, তেমনিভাবে নজিরবিহীন আঘাত লেগেছে ইউরোপের দেশগুলোতে।
করোনার কারণে কোন দেশই অর্থনীতির অবনতি এড়াতে পারবে না। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশই কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে মন্দার কবলে পড়েছে। বিশেষ করে, ঋণগ্রস্ত অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্হা আরও খারাপের দিকে যাবে। যেসকল দেশ বা প্রতিষ্ঠান এসব দেশে বিনিয়োগ করে তারা আর ঋণ দিবে না। ফলে, এসব দেশে ঋণ গ্রহণের ব্যয়ভার আরও বেড়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, বিশ্বের অর্থনীতি এই বছরে অন্তত তিন শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যেহেতু, কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতির অবনতি হচ্ছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথের মতে, করোনা সংকটের ফলে সামনের দুই বছর ধরে বিশ্বের প্রবৃদ্ধি ৯ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবছর ৫.৯ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২১ সাল নাগাদ সেটি আংশিক পুনরুদ্ধার হতে পারে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪.৭ শতাংশ। এবছর যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হারও বেড়ে ১০.৪ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীনে এবছর প্রবৃদ্ধি ১.২ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ১৯৭৬ সালের পর সবচেয়ে শ্লথগতির।
এদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হা একটি প্রতিবেদনে বলছে যে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিনমাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে। আমেরিকার দেশগুলোর চাকরি হারাবে দুইকোটি ৪০ লাখ কর্মী, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দুই কোটি, আরব দেশগুলোর প্রায় ৫০ লাখ ও আফ্রিকার এক কোটি ৯০ লাখ কর্মী।
এতে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। করোনার কারণে, দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন শিল্প, সরবরাহ ব্যবস্থা, বস্ত্রশিল্প, ক্রেতা বা বিনিয়োগকারীর কাজেও ধাক্কা লেগেছে। করোনা মহামারির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে মন্দা, কোনও দেশে বা মহামন্দাও দেখা দিতে পারে বলে মত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
চলতি আর্থিক বছরে, এইসব দেশে অর্থনেতিক বৃদ্ধির হার কমে দাড়াঁতে পারে ১.৮ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন নির্ভর দেশ মালদ্বীপ। বিশ্বব্যাংক আরো বলছে, আর্থিক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও সামাজিক বৈষম্যের খাতেও বড়সড় ভাটার টান পড়বে দক্ষিণ এশিয়ায়।
করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো সংরক্ষণবাদিতা। বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো এখন নিজেকে নিয়ে সদাব্যস্ত। উদাহরণ হিসাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইউরোপ -কানাডার মাস্ক ছিনতাইয়ের কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে। তাছাড়া, বিশ্বের ৫৪ টি দেশ চিকিৎসা পণ্য রপ্তানিতে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার উল্লেখও করা যেতে পারে।
খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রধান গম উৎপাদক দেশ হিসাবে পরিচিত দেশ কাজাখিস্তান, রাশিয়া তাদের রপ্তানির হার কমিয়ে দিয়েছে। এশিয়ায় কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম উভয়ে চাল রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণারোপ করেছে। এই সংরক্ষণবাদী অর্থনীতির কারণে সামনের দিনগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো এবং এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো।
সাময়িকভাবে, অর্থনীতিকে বাচাঁনোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো নানা প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু, এই আপদকালীন প্রণোদনার ভার পরবর্তীতে জনগণকেই বইতে হবে। পরবর্তীতে, সরকারগুলো ব্যয় সংকোচন ও কর হার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। এজন্য বলা যায় যে, বিশ্ব অর্থনীতি এখন আইসিইউতে চলে গেছে। করোনাকালীন বিশ্ব নেততৃবৃন্দ ও অর্থনীতিবিদদের চিন্তা বা পরিকল্পনা করতে হবে কিভাবে এই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যায় তা নিয়ে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নতুন কাঠামো বা বিদ্যমান কাঠামোর বড় ধরণের সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার যুদ্ধে বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে ছোট অর্থনীতির দেশগুলোকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। করোনা মহামারি সামলাতে চারটি অগ্রাধিকার নিধারর্ণ করেছে আইএমএফ।
সেগুলো হলো- স্বাস্হ্যখাতের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো, কর্মী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিক সহায়তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অব্যাহত সহযোগিতা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি পরিষ্কার বিকল্প পরিকল্পনা। পাশাপাশি, বিশ্ব অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়ন সহায়ক করার জন্য কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে প্রকৃতিবান্ধব ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। যথাযোগ্য পরিকল্পনা ও সম্মিলিত উদ্যোগেই পারে এই অর্থনেতিক মন্দা থেকে বিশ্ববাসীকে বাচাঁতে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা