মনুষ্যত্বের পরীক্ষা ও এক বেলা আহার
আমার বাসা থেকে অফিসে রিকশায় আসা-যাওয়ায় খরচ হয় তিনশ টাকা। কোনোদিন বন্ধুরা একসঙ্গে বসে আড্ডাবাজি করে বিকালে চা-নাস্তা করলে পকেট থেকে বড় নোট নাই। তারপরেও অল্পতেই বন্ধুদের কতো আনন্দ। নাই নাই কথাবার্তা নিয়ে খিলখিল হাসি। তিনশ-পাঁচশ টাকা এখন কোনো বড় বিষয় না। কিন্তু মাত্র তিনশ টাকায় একটি বড় বিষয় ঘটিয়ে ফেলেছে আমার বন্ধু রেদোয়ান আতিক।
অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে পুরো বিশ্ব। সবাই ঘরে থাকার চেষ্টা করছেন। বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বড় নিষ্ঠুর এই শহর। এখানে মৃত্যুর চেয়ে ক্ষুধার ভয় বেশি। সুকান্তের সেই কবিতা ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পুরো বাংলাদেশ যখন লকডাউন। তখন খেটে খাওয়া মানুষগুলো পড়েছেন বিপাকে। কাজ নেই; তাই তিনবেলা খাবার জোটে না। অনাহারে ক্লিষ্ট মুখগুলোতে হাসি নেই।
আমার বন্ধু রেদোয়ান প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় চাল কিনে, ডাল কিনে, ডিম কিনে বাসায় নিয়ে যায়। তিনশ টাকা খরচ হয়। এরপর ভাবির কাজ শুরু। এদিকে চমৎকার, সুস্বাদু ডিম খিচুরি রান্না করেন আমাদের সাবরিনা ভাবি (বন্ধুর বউ ছাড়াও ওর আরেকটি পরিচয় হচ্ছে ও আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের বন্ধু)। রান্না-বান্না শেষ। এরপর রেদোয়ান ১৫ জনের খাবার প্যাকেট করে রাতে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম ছোট পলিব্যাগে ভরে খাবার নিয়ে বের হতো। একটু লজ্জা লজ্জা করতো রেদোয়ানের। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে যখন অভুক্ত মানুষের হাতে প্যাকেটটি দিতো, তখন দেখতো তৃপ্তি নিয়ে খাবার খাচ্ছেন তারা। অন্য কোথাও তাকানোর তাদের সময় নেই। হাতে করে আনা প্যাকেট ফুরিয়ে যায়; কিন্তু অভুক্ত মানুষের সংখ্যা কমে না। তখন আফসোস হয় রেদোয়ানের। অভুক্ত মানুষকে অন্তত একবেলা যদি খাওয়ানো যেতো। রেদোয়ান ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলেছে ‘এক বেলা আহার’। সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে মাত্র তিনশ টাকায় ১৫ জনকে একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। অনেক সহৃদ বন্ধু রেদোয়ানের কাজে উৎসাহ দিতে আর্থিক সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু রেদোয়ানের ভাবনাটা হচ্ছে— প্রতিদিন তো আমরা রান্না করে খাই। কষ্ট করে তিনশ টাকা খরচ করে ১৫ জনের খাবার রান্না করে খাওয়ানো। রেদোয়ান আর সাবরিনার পক্ষে অনেক মানুষের জন্য রান্না করা সম্ভব নয়। কিন্তু শুরুটা করেছে ওরা। আর এটি এখন ছড়িয়ে দেওয়ার পালা।
বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়ানো এই করোনাভাইরাস আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে ‘মনুষ্যত্ব’ ও ‘মানবসেবা’। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের আমরা অস্পৃশ্য করছি। আমাদের খবর পড়তে হয়, ‘করোনাভাইরাসের লক্ষণ থাকায় মাকে ফেলে দিয়ে গেলো ছেলে’, ‘গোসলের জন্য মসজিদ থেকে দেওয়া হচ্ছে না খাটিয়া’, ‘দাফন করতে দিচ্ছে না এলাকাবাসী’, ‘লাশ পড়ে আছে বাড়ির নীচে’। হে, ধরণী দ্বিধা হও। এই অদৃশ্য ভাইরাস পরাজিত হবে। মহাসংকট কেটে যাবে। আলো ফুটবেই। কিন্তু আমরা কতটুকু মানুষ হতে পেরেছি তার প্রমাণের সুযোগ এখন।
লেখক: সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক ও গবেষক